সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সমস্যা না হওয়ার কারণসমূহ ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

বৈশ্বিক ব্যাংক খাতে যেসব কারণে সংকট তৈরি হয়েছে, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও ব্যাংকিং নীতিমালায় পার্থক্য থাকায় বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত ৬১টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা খুব একটা প্রযোজ্য নয়। আমাদের ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ সর্বক্ষণ কড়া নজরদারি জারি রাখছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক ব্যাংক পতনের প্রভাব নিয়ে জনসাধারণের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
নতুনধারা
  ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিলভার গেট ব্যাংক, সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকিং খাতে সংকট সৃষ্টি হবে কি না সে নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা সম্পর্কিত এই প্রশ্ন আরও ঘনীভূত হয়েছে সুইজারল্যান্ডের প্রভাবশালী ব্যাংকের রক্ষা পাওয়ার ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করে। সেখানে সুইজারল্যান্ড ক্রেডিট সুইস ব্যাংককে পতনের মুখ থেকে তাদেরই প্রতিদ্বন্দ্বী ইউনিয়ন ব্যাংক অব সুইর্জাযল্যান্ড অধিগ্রহণের মাধ্যমে রক্ষা করেছে! একই সঙ্গে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আরো ১৮৬ ব্যাংক পতনের ঝুঁকিতে শিরোনামে খবর প্রচার হচ্ছে। বিশ্বায়নের এ যুগে এক দেশের সংকটের প্রভাব অন্য দেশগুলোতেও দ্রম্নত জড়িয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সার্বিক অর্থনীততে তার প্রভাব পড়বে না। কারণ অন্যান্য দেশের ব্যাংকিং নীতির সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকিং নীতির বেশ পার্থক্য রয়েছে। তাই কাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো সংকটে পড়ার সম্ভাবনা নেই। দেশের আর্থিক খাতে বৈশ্বিক ব্যাংক পতনের কোনো প্রভাব না থাকার কারণসমূহ।

(১) বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ নেই : যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রা) বড় বিনিয়োগ। ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি ভার্চুয়াল কারেন্সি। এর পেছনে কোনো অ্যাসেট নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ না হলেও আমাদের দেশে তা নিষিদ্ধ। ফলে এই ঝুঁকি থেকে দেশের ব্যাংকগুলো নিরাপদ।

\হ(২) বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদের হার সামান্য বাড়িয়েছে: যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি করেনি। তারা ধীরে ধীরে নীতি সুদের হার সামান্য বাড়িয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কিছুটা বাড়লেও মূল্যস্ফীতির হার কমাতে ও মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটি করেছে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব খুব বেশি পড়েনি।

(৩) বাংলাদেশের বাংকগুলোর বিনিয়োগ একটা নির্দিষ্ট খাতে পুঞ্জীভূত নয়: যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো স্টার্টআপের মতো ছোট উদ্যোগে ও গৃহায়ণ খাতে বড় বিনিয়োগ করেছিল। আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর নির্দিষ্ট কোনো খাতে এক তরফা বিনিয়োগ নেই, ফলে তারা বড় ক্ষতির শঙ্কামুক্ত।

(৪) শেয়ারবাজারেও প্রভাব নেই : বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বৈশ্বিক অন্তর্ভুক্তি খুবই কম। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশের স্টক মার্কেটের মধ্যেকার সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এই দু'টি চলকের মধ্যে কোনো পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার উলেস্নখ্যযোগ্যভাবে বাইরের কোনো দেশের অর্থনৈতিক মন্দার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। অতএব, বৈশ্বিক ব্যাংক পতনের ফলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

(৫) বাংলাদেশের ইনফর্মাল ইকোনমি যথেষ্ট শক্তিশালী: বাংলাদেশের ইনফর্মাল ইকোনমি মোট জিডিপির একটা উলেস্নখযোগ্য অংশ- যা ব্যাংকিং সেক্টরের আওতাভুক্ত নয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৫% থেকে ৮৮% কর্মশক্তি ইনফর্মাল ইকোনমিতে নিযুক্ত, এবং ইনফর্মাল ইকোনমি দেশের জিডিপির প্রায় ৪৯% থেকে ৬৪% অবদান রাখে। কৃষি খাত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইনফর্মাল খাত। অতএব, বৈশ্বিক ব্যাংক পতনের প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পড়বে না।

(৬) তৈরি পোশাক খাতেও প্রভাব নেই: যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যাংকগুলোর অবস্থান স্থিতিশীল ও শক্তিশালী থাকায় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাকের অর্থ লেনদেনেও কোনো সমস্যা হবে না।

বৈশ্বিক ব্যাংক খাতে যেসব কারণে সংকট তৈরি হয়েছে, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও ব্যাংকিং নীতিমালায় পার্থক্য থাকায় বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত ৬১টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা খুব একটা প্রযোজ্য নয়। আমাদের ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ সর্বক্ষণ কড়া নজরদারি জারি রাখছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক ব্যাংক পতনের প্রভাব নিয়ে জনসাধারণের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। পরিশেষে বলা যায় বৈশ্বিক ব্যাংকগুলো পতনে গুজবেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল। গুজব আর্থিক খাত ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার। তাই স্বার্থন্বেষী মহল কর্তৃক সৃষ্ট গুজবে কর্ণপাত না করে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি আস্থা রাখার মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করাই কাম্য।

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থের লেখক এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা; সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে