সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চড়ামূল্যে পণ্য বিক্রি :ইসলামের নির্দেশনা

অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করাকে ইসলামে অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে উলেস্নখ করে তাদের শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাইতো নবী (স) বলেছেন, 'কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আলস্নাহ্‌ তায়ালা আগুনের হাড়ের উপর তাকে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।
ড. আবদুল আলীম তালুকদার
  ০৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

গত কয়েক বছর ধরে ধাপে ধাপে প্রায় সব পণ্যের দাম শুধু হু হু করে বাড়ছে তো বাড়ছেই। গৃহ নির্মাণসামগ্রী থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় টয়লেট টিসু্যপেপারেরও দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের মতে, একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে নিজেদের মতো করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রায় সব জিনিসপত্রের দাম দিনে দিনে বাড়িয়েই চলেছে। সরকারের নানামুখী নজরদারি ও পদক্ষেপসহ কোনো প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের গতি। অথচ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বর্ধিত মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টা একটি সামাজিক অপরাধ।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। সব বিষয়ের মতো ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও রয়েছে নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট মূলনীতি। সেমতে, মহান আলস্নাহ্‌র সৃষ্টি মানুষ কোনো ক্ষেত্রেই বল্গাহীন স্বাধীনতা পেতে পারে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বর্তমানে দেশের জাতীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। অধিকাংশ নিত্যপণ্যের মূল্যই এখন নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অথচ ইসলামে জালিয়াতি, ধোঁকাবাজি, ভেজাল মেশানো, ওজনে কম দেয়া ইত্যাদি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। আর জিম্মি করে বা ক্রেতার অজ্ঞতার সুযোগে অধিক মুনাফা অর্জন সম্পূর্ণ হারাম।

আমাদের দেশে সুযোগসন্ধানী মজুতদার ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা সাধারণত পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এখন এটা একটা রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মজুত করে রেখে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এতে করে তারা ক্রেতাদের কষ্ট দিয়ে অবৈধ ও অযাচিত আনন্দ অনুভব করে আর অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্য মজুত করে- যা ইসলামে সম্পূর্ণ অবৈধ। অসাধু ব্যবসায়ীরা হয়তো মনে করতে পারে, এভাবে তারা অল্পদিনে লাভবান ও বিত্তশালী হয়ে যাবেন। বস্তুত এ ধরনের অবৈধ সম্পদ আয় করে সুখ পাওয়া যায় না। ভোক্তাদের জিম্মি করে অর্থকড়ি উপার্জন ঘৃণ্য ও সভ্যতাবিবর্জিত। উপরন্তু এগুলো পরকালে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে।

মজুতদারি করে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি মানব সম্প্রদায়ের ওপর এমন একটি জুলুমকার্য যার কারণে আলস্নাহ্‌ তায়ালা এদের মহামারি ও দারিদ্রতায় নিক্ষেপ করেন। তাইতো নবী (স.) মজুতদারদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, 'কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে (মজুতদারি করে), তবে আলস্নাহ্‌ তায়ালা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্যতা চাপিয়ে দেন।' (আবু দাউদ: ৫৫, ইবনে মাজাহ্‌: ২২৩৮)

সাধারণত ব্যবসার লক্ষ্যই থাকে মুনাফা লাভ করা এবং ইসলামেও তা নিষিদ্ধ নয়। ইসলাম ব্যবসায়ীকে মুনাফা থেকে বঞ্চিত করে না। বরং ইসলাম সব সময় ব্যবসাবাণিজ্য করা ও মুনাফা অর্জনকে হালাল ও উৎসাহিত করেছে। পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেন, 'আলস্নাহ্‌ ক্রয়-বিক্রয়কে (ব্যবসা) হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাক্বারা: ২৭৫)

বাজার ব্যবস্থায় মধ্যসত্ত্বভোগীদের অপতৎপরতার কারণেও অনেক ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের অবৈধভাবে মুনাফা লাভের আশায় এহেন ঘৃণিত কাজটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুলস্নাহ্‌ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) স্বল্পমূল্যে কেনার জন্য বহিরাগত বিক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করেছেন (সুনানে তিরমিজি)। অর্থাৎ পণ্যের মালিক বা বাণিজ্যিক কাফেলা বাজারে পৌঁছার আগেই তাদের কাছ থেকে অধিক মুনাফার লোভে পণ্য কেনা রাসূল (স.) নিষিদ্ধ করেছেন। কারণ, এতে সাধারণ ক্রেতা ও ভোক্তাদের স্বার্থ বিনষ্ট হয় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।

মজুতদারির ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয় ও বাজারে পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পায়। এ জন্য ইসলামী শরিয়াতে একে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেননা, এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং বেশির ভাগ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত মা'মার ইবনে আবদুলস্নাহ্‌ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন। রাসূল (স.) বলেছেন, 'জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে সে বড় অপরাধী। আর জেনে রাখো, সে পাপী হিসেবে আলস্নাহ্‌র সামনে দাঁড়াবে। সহিহ্‌ মুসলিম: ১৬০৫)

রাসূলুলস্নাহ্‌ (স.) মজুতদারকে পাপী বলে আখ্যা দিয়েছেন। যেমন নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, 'পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী।' (ইবনে মাজাহ্‌: ২২৩৮, মিশকাত শরিফ, পৃ. ২৫০)

এছাড়াও হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (স.) বলেছেন, 'মূল্য বাড়ার উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুত রাখে, সে ব্যক্তি আলস্নাহ্‌র দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আলস্নাহ্‌ তার প্রতি অসন্তুষ্ট। সে মজুতকৃত সম্পদ দান করে দিলেও তার গুনাহ্‌ মাফের জন্য যথেষ্ট হবে না।' (মিশকাত শরিফ:২৭৭২)

নবী (স.) মজুতদার ও কালোবাজারিদের অভিশপ্ত উলেস্নখ করে বলেন, 'যে ব্যক্তি আমদানি করবে সে রিজিকপ্রাপ্ত হবে। আর যে গুদামজাত করবে, সে অভিশপ্ত হবে। (ইবনে মাজাহ্‌: ২১৪৪)

অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করাকে ইসলামে অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে উলেস্নখ করে তাদের শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তাইতো নবী (স.) বলেছেন, 'কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আলস্নাহ্‌ তায়ালা আগুনের হাড়ের উপর তাকে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।

এছাড়াও হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, আমি নবী (স.) কে বলতে শুনেছি, 'মজুতদার ব্যক্তি খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দর হ্রাস পায়, তখন সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দর বেড়ে যায়, তখন আনন্দিত হয়। (মেশকাত শরিফ: ২৭৭১) পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বর্ধিত মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করা একটি গুরুতর অপরাধ এবং তা করা ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী সম্পূর্ণ হারাম। আলস্নামা ইবনে হাজার হাইতামি (রহ.) গুদামজাত করে মূল্য বৃদ্ধি করাকে কবিরা গুনাহ্‌ বলে উলেস্নখ করেছেন। (নিহায়াতুল মুহতাজ: ৩/৪৫৬) পরিশেষে বলা যায় যে, ইসলাম অবৈধভাবে পণ্য মজুত ও সুযোগ বুঝে পণ্যের চড়া মূল্য নির্ধারণকে সব সময় নিরুৎসাহিত করে থাকে। আর ব্যবসায়ীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সুলভ মূল্যে বিক্রয় করার প্রতি বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেছে। হাদিসে কারিমায় সৎ ব্যসায়ীদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীরা কিয়ামতের দিন নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে অবস্থান করবেন।

ড. আবদুল আলীম তালুকদার : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে