সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংকটের জালে পোলট্রি শিল্প

দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোলট্রি শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রপ্তানি করলে এই শিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনেকাংশে বেকার সমস্যা দূর করাসহ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
এম এ কাদের
  ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

দেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য মুরগি উৎপাদনের কোনো বিকল্প নেই। দেশে প্রতিদিন মুরগির চাহিদা আছে প্রায় ২ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে এই শিল্পে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। বেকার সমস্যা দূরীকরণেও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে।

আমাদের দেশে পোলট্রি শিল্প আশির দশকে শুরু হলেও মূলত ২০০০ সালের পর থেকে এর বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে আমাদের দেশে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারির সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৮০টি। ইতিপূর্বে এই হ্যাচারিগুলো থেকে প্রতিদিন বাচ্চা উৎপাদন হতো প্রায় ২৩ থেকে ২৫ লাখ পিস, কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৭ থেকে ৮ লাখ পিস। হ্যাচারিগুলোর মুরগির বাচ্চা কম উৎপাদনের কারণ হিসেবে জানা যায় দীর্ঘমেয়াদি লোকসানের কারণে হ্যাচারিগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনের খরচের চেয়ে অনেক কম মূল্যে বিক্রয় হয়েছে। ঝিনাইদহের ইউনিভার্সাল পোলট্রি হ্যাচারির বাচ্চা বিক্রয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রতিটি বাচ্চার উৎপাদন খরচ ছিল ৩৪ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে। কিন্তু ২০১৯ সালে গড় বাচ্চা বিক্রয়মূল্য ছিল প্রতি পিস মাত্র ২৭ টাকা, ২০২০ সালে ছিল মাত্র ১৪ টাকা, ২০২১ সালে ছিল মাত্র ২৯ টাকা ও ২০২২ সালে গড় বাচ্চা বিক্রয়মূল্য ছিল প্রতি পিস মাত্র ২৭ টাকা। ২০১৭ সালে প্রতি কেজি মুরগির খাদ্যের মূল্য ছিল মাত্র ২৬ টাকা, ২০১৮ সালে ছিল মাত্র ২৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ২০১৯ সালে ছিল মাত্র ২৮ টাকা ১৫ পয়সা, ২০২০ সালে ছিল মাত্র ৩১ টাকা ৫০ পয়সা, ২০২১ সালে ছিল মাত্র ৩৬ টাকা ৫০ পয়সা, ২০২২ সালে প্রতি কেজি খাদ্যের দাম বেড়ে হলো ৪২ টাকা ৯০ পয়সা, ২০২৩ সালের শুরু থেকেই বর্তমানে প্রতি কেজি মুরগির খাদ্যের দাম বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা। একই নিয়মে মুরগি পালনে ভ্যাক্সিন, মেডিসিন, খাদ্য উপকরণ ও সরঞ্জামাদি, বিদু্যৎ, ডিজেল, শ্রমিকের বেতন ও পরিবহণসহ যাবতীয় সবকিছুর দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন। গত ৫ বছরে হ্যাচারিগুলোর লোকসানের কারণ ছিল চাহিদার তুলনায় অধিক উৎপাদন, পোলট্রি চাষে বিদেশি কোম্পানিদের অনুপ্রবেশ, শুধু রান্নার মাংস হিসেবে ব্যবহার করা, বিদেশে রপ্তানি না হওয়া, সরকার কর্তৃক উৎপাদিত মুরগির নির্ধারিত মূল্য না থাকা ও রোগ নির্ণয়ের জন্য ডাক্তার-ল্যাবরেটরি না থাকা। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে করোনার প্রভাব, মুরগির মাংসের উপকারিতা সম্পর্কে ভোক্তার ধারণা না থাকা, মুরগির খাদ্য, ঔষধ-ভ্যাক্সিন, অন্যান্য উপকরণের অধিক মূল্য বৃদ্ধি এবং পোলট্রি মুরগি নিয়ে অপপ্রচার।

২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে উৎপাদিত কমার্শিয়াল ব্রয়লার মুরগি উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১২৫ টাকার মধ্যে, কিন্তু এ দীর্ঘ সময় ধরে ব্রয়লার মুরগির পাইকারি মূল্য বেশির ভাগ সময়ে ছিল ৯৫ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে। গত ৫ বছরে ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলো কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়ে বন্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, অধিকাংশ কমার্শিয়াল ফার্মগুলো দীর্ঘমেয়াদি লোকসানের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এই দীর্ঘমেয়াদি লোকসানের কারণেই একদিকে হ্যাচারির বাচ্চা উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসছে, অন্যদিকে কমার্শিয়াল ব্রয়লার মাংস উৎপাদনকারী ফার্মগুলো মূলধন ও বাচ্চা সংকটের কারণে বর্তমানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

প্রোটিনের উৎস হিসেবে উন্নত বিশ্বে যেমন কানাডা, জাপান, আমেরিকায় বছরে একজন মানুষ গড়ে মাংস খায় প্রায় ৪২ থেকে ৪৪ কেজি। মালয়েশিয়ায় প্রতিজন গড়ে বছরে মুরগির মাংস খাচ্ছে ৪০ কেজি। সেখানে আমাদের দেশে প্রতিজন মুরগির মাংস খায় বছরে মাত্র ৪ থেকে ৫ কেজি। উন্নত দেশের মানুষ আমাদের দেশের তুলনায় মুরগির মাংস খায় ৮ থেকে ৯ গুণ বেশি, ডিম খায় ৭ থেকে ৮ গুণ বেশি। দেশে মুরগির মাংস এবং ডিমের চাহিদা এত কম থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন বাচ্চা ও মুরগির দাম না বাড়ার কারণ ছিল বিদেশি কোম্পানিগুলোর দেশে অনুপ্রবেশ। ইতোমধ্যে থাইল্যান্ড কোং সিপি বাংলাদেশ, চায়নার নিউহোপ, ইন্দোনেশিয়ার জাফপা ভারতের সগুনা ও ভেনকিজ প্রচুর পরিমাণে বাচ্চা ও ডিম উৎপাদন করছে। দেশে চাহিদা অনুযায়ী ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন না হওয়ায় কখনো উৎপাদিত বাচ্চার দাম প্রতি পিস ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা আবার কখনো ৫০ টাকা থেকে ৭০ টাকা হচ্ছে। এতে একদিকে হ্যাচারি ও কমার্শিয়াল ফার্ম লোকসান গুনছে, অন্যদিকে কখনো কখনো অধিক হারে বাজার বেড়ে যাচ্ছে।

মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মুরগির মাংসের মাধ্যমে প্রোটিনের অভাব দূর করা সম্ভব। চাহিদা মতো মুরগির মাংস খেলে প্রোটিনের অভাব পূরণের মাধ্যমে নিউরোট্রান্সমিটার সঠিকভাবে কাজ করবে। এতে মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, কাজের স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

মৃতপ্রায় পোলট্রি শিল্প রক্ষার্থে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় (প্রাণিসম্পদ) কে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত পোলট্রি শিল্পকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। বিদেশি যে সমস্ত বড় বড় মুরগির ফার্ম আমাদের দেশে জেকে বসেছে, সেগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের বড় বড় বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, হ্যাচারিগুলোকে অবশ্যই শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে চাহিদা অনুযায়ী বাচ্চা উৎপাদন করতে হবে, অথবা উৎপাদনের সঙ্গে মিল রেখে মুরগির মাংস বিদেশে রপ্তানি করতে হবে। হ্যাচারির উৎপাদিত ব্রয়লার বাচ্চার মূল্য প্রতি পিস কমপক্ষে ৫০ টাকা ও উৎপাদিত মুরগির দাম কমপক্ষে ২০০ টাকা প্রতি কেজি নির্ধারণ করতে হবে। দেশের মানুষের মুরগির মাংস খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জোর প্রচার করতে হবে। শুধু রান্না করে খাওয়া নয়, উন্নত দেশের মতো বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে মুরগির মাংস সংযুক্ত করে দেশে-বিদেশে রপ্তানী করতে হবে।

দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোলট্রি শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রপ্তানি করলে এই শিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনেকাংশে বেকার সমস্যা দূর করাসহ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

এছাড়া মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করে ফসলের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানি অনেকাংশ কমানো সম্ভব। কাজেই এ শিল্পকে অবহেলার চোখে না দেখে, এখনই সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সু-পরিকল্পিতভাবে পোলট্রি নীতি বাস্তবায়িত হলে মৃতপ্রায় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। এতে বেকার সমস্যা দূর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।

এম এ কাদের :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে