বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

হাওড়াঞ্চলের শিক্ষা পরিস্থিতি

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় সুনামগঞ্জের পিছিয়ে পড়া শুধু পরিবেশগত ও প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা নয়; স্থানীয় নেতৃত্ব, বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের নেতৃত্ব দূরদর্শিতা, ইমপ্যাক্ট লিডারশিপ সক্ষমতা এবং আবেগ-বুদ্ধিমত্তা ও নৈতিকতাও এখানে বড় প্রশ্ন।
ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার
  ০৩ মে ২০২৩, ০০:০০
হাওড়াঞ্চলের শিক্ষা পরিস্থিতি

হাওড়াঞ্চলের শিক্ষার অবস্থা খারাপ, তার মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার শিক্ষার অবস্থা একেবারেই বেহাল। এটা শুধু প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা না; নেতৃত্ব দূরদর্শিতা, সক্ষমতা এবং আবেগ-বুদ্ধিমত্তা ও নৈতিকতাও এখানে বড় প্রশ্ন।

পুরো সুনামগঞ্জ জেলা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার একটা বড় অংশ এবং সিলেট সদর উপজেলার একাংশ, পাশাপাশি কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বাইরের অংশ মিলে এই বিস্তৃত অঞ্চলটা হাওড় অববাহিকা বা হাওড় এলাকা হিসেবে পরিচিত। এই অববাহিকা নদী, স্রোত এবং সেচ খাল, মৌসুমী পস্নাবন, চাষের সমভূমির বিশাল এলাকা এবং শত শত হাওড়-বিলসহ জলাভূমি-ইকোসিস্টেমের এক নান্দনিক মোজাইক- যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

বর্ষাকালে হাওড় হলো বিস্তীর্ণ উত্তাল জলরাশি। বর্ষাকালে হাওড়গুলো একীভূত হয়ে সমুদ্ররূপে পরিণত হয় যার মধ্যে গ্রামগুলোকে দ্বীপ হিসেবে দেখা যায়। যদিও বর্ষা-পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগই শুকিয়ে যায়, তথাপি বছরের প্রায় অর্ধেক সময় আমরা হাওড়ের যৌবনরূপ দেখতে পাই।

এই হাওড় অববাহিকায় প্রায় ৪০০টি হাওড় ও বিল রয়েছে, যাদের এক একটির আয়তন কয়েক হেক্টর থেকে কয়েক হাজার হেক্টর পর্যন্ত। সুনামগঞ্জ জেলার উলেস্নখযোগ্য হাওড়গুলো হলো- শনির হাওড়, মাটিয়ান হাওড়, হালির হাওড়, কড়চা হাওড়, পাকনা হাওড়, ধলা পাকনা হাওড়, আঙ্গরখালি হাওড়, খচ্চর হাওড়, নখলা হাওড়, সানুয়াডাকুয়া হাওড়, শৈল চকরা হাওড়, হৈশাম হাওড়, বড় হাওড়, হালিয়ার হাওড়, চন্দ্রসোনার থাল হাওড়, ডিঙ্গাপুতা হাওড়, দেখার হাওড় এবং পৃথিবীখ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওড়।

সুনামগঞ্জের বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হাওড়াঞ্চলটি নিম্নভূমি এবং বন্যাপ্রবণ জলাভূমি দ্বারা আবৃত। এখানকার হাওড় পাড়ের মানুষ প্রাথমিকভাবে কৃষি থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ভান্ডার এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির সমীরণে অসাধারণ ইকোসিস্টেম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এলাকাটি দেশের সবচেয়ে অনুন্নত ও অবহেলিত এলাকা। 'সরেজমিন হাওড়াঞ্চল- দুর্গম হাওড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার সংকট' শিরোনামে ২৬ ফেব্রম্নয়ারি ২০২২ প্রকাশিত প্রথম আলো প্রতিবেদন অনুসারে, 'হাওড়ের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করে। কেউ কেউ কৃষিকাজের ফাঁকে মাছ ধরে। কিন্তু অবারিত হাওড়ে এখন আর আগের মতো মাছ ধরতে যেতে পারে না। কারণ, হাওড়ের জলমহালগুলো স্থানীয় ভাষায় 'ওয়াটারলর্ডদের' দখলে।'

হাওড়াঞ্চলের শিক্ষার অবস্থা খারাপ, তার মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার শিক্ষার অবস্থা একেবারেই বেহাল। এটা শুধু প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা না; নেতৃত্ব দূরদর্শিতা, সক্ষমতা এবং আবেগ-বুদ্ধিমত্তা ও নৈতিকতাও এখানে বড় প্রশ্ন।

হাওড়াঞ্চলে শিক্ষা

শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কিন্তু দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হাওড় জনপদে শিশুরা মানসম্মত শিক্ষা, এমনকি অনেকে মৌলিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। হাওড় এলাকায় বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা বা কর্মমুখী শিক্ষার সুযোগ পাওয়া একটি উলেস্নখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।

হাই স্কুলের গন্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ে একটা বড় অংশ, হাই স্কুল পেরিয়ে যে সামান্য অংশটা কলেজে যায় তাদের অধিকাংশের ভীত থাকে খুব দুর্বল। এর মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষা মান ও সুযোগও খারাপ, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অপ্রতুলতা তো আছেই। কলেজের সংখ্যাও অপ্রতুল এবং মানসম্মত কলেজ হাতেগোনা কয়েকটা মাত্র, তাও সেগুলো জেলা শহরগুলোতে।

না আছে উচ্চ শিক্ষা সুযোগ, না আছে কর্মমুখী শিক্ষার ভালো সুযোগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয় কেবল স্থাপিত হয়েছে। তার ফল পেতে আরও যথেষ্ট সময় লাগবে। নেত্রকোনায় ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হলেও সুনামগঞ্জে তা চালু হতে আরও কয়েক বছর লাগবে। এর আগে পুরো হাওড় অববাহিকার জন্য ছিল সিলেটে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলা এবং নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার উচ্চ শিক্ষা সুযোগপ্রত্যাশীরা সাধারণত চলে যেত ময়মনসিংহ বা ঢাকায়।

সুনামগঞ্জের বাস্তবতা

২০২১ সালে পরিচালিত জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন ২০২২-এ প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়- সাত বছর বা তারও বেশি বয়সিদের মধ্যে বাংলাদেশের গড় সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ যা ২০১১ সালে পরিচালিত আদমশুমারি থেকে ২২.৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি দেখায়। আগের শুমারিতে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১.৭৭ শতাংশ (সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো, ২০১১ এবং ২০২২)।

জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রাথমিক প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী জাতীয় গড় থেকে সবচেয়ে কম সাক্ষরতার হার পাঁচটি জেলার একটি সুনামগঞ্জ। বাকি চারটি হচ্ছে জামালপুর, শেরপুর, বান্দরবান ও কুড়িগ্রাম। সুনামগঞ্জের সাক্ষরতার হার ৬৪.৭৭ শতাংশ (সূত্র: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো, ২০২২)। অন্যদিকে সিলেট বিভাগের চারটি জেলার মধ্যেও সবচেয়ে কম সাক্ষরতার হার সুনামগঞ্জে।

শিক্ষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও নান্দনিকতাসহ প্রায় সব দিক থেকেই সিলেট অঞ্চল ছিল অনন্য উচ্চতায়। দুঃখজনকভাবে সত্য ১৯৬০ দশক থেকে সিলেট অঞ্চল শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। ইউনিসেফ প্রকাশিত ২০১০ সালের এক প্রতিবেদন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাকে 'বঞ্চনা সূচক' অনুযায়ী ভাগ করে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের আটটি জেলা সবচেয়ে বেশি 'বঞ্চিত', তার দুটোই (অর্থাৎ সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ) সিলেট বিভাগে (দেখুন, আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরীর বণিকবার্তায় মে ২৪, ২০২২ প্রকাশিত প্রবন্ধ 'শিক্ষাবৈষম্য ও মানব উন্নয়ন সূচকে সিলেট')।

শিক্ষার বিভিন্ন সূচকের মধ্যে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিলেট বিভাগ বা সিলেট অঞ্চল পিছিয়ে আছে (পূর্ব সূত্র)। চিত্রটা অনেকটা নিম্নরূপ-

'প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ক্ষেত্রে স্কুলে নিট গমন হার, ঝরে পড়ার হার, সাইকেল পূর্ণতার হার একটি শিক্ষা ব্যবস্থার নির্ণায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। দুঃখজনকভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিলেট (অঞ্চল) বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে পিছিয়ে আছে। সিলেটের প্রাথমিক স্কুলে নিট গমন হার দেশের গড় হারের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ কম। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের নিট গমন হার একটু বেশি। মাধ্যমিক ক্ষেত্রে স্কুলে নিট গমন হার দেশের গড়ের প্রায় সমান সমান। ঝরে পড়া ও সাইকেল পূর্ণতার হারের দিক থেকে সিলেট পিছিয়ে আছে। সাক্ষরতার হার একটি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সার্বিক অবস্থা নির্দেশ করে। সেখানেও আমরা সিলেটকে পেছনে দেখতে পাই (পূর্ব সূত্র)।'

সিলেট বিভাগের দুটি জেলায় সাক্ষরতার হার জাতীয় গড় থেকে অনেক কম। সিলেটের এই দুটি জেলাকে- অর্থাৎ সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জকে সম্পূর্ণ অর্থেই দুর্বল অবকাঠামোর ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ভঙ্গুর হাওড় শিক্ষাব্যবস্থা বলা যায়। তার মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলা শুধু সাক্ষরতার হার না, শিক্ষার উৎকর্ষতার সব দিক দিয়েই জাতীয়ভাবে এবং সিলেট বিভাগের মধ্যে পিছিয়ে, অর্থাৎ শিক্ষমান, শিক্ষা সুযোগ-সুবিধা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যায় পিছিয়ে।

সারা দেশের মধ্যে ঝরে পড়ার হার সুনামগঞ্জে সর্বাধিক। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যেমন- কমিউনিটির প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পর্যাপ্ত সংখ্যক ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নিম্ন গ্রেড এবং ঊর্ধ্ব গ্রেডের নিবন্ধন সংখ্যার মধ্যে স্থিতি, সারা বছর চালু থাকার সুযোগ, সারা বছর পাওয়া খেলার মাঠ, স্কুলে যাতায়াত ব্যবস্থা এবং যাতায়াত অবকাঠামো, স্কুলে বিদু্যৎ, খাবার পানি এবং মেয়েদের শৌচাগার- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুনামগঞ্জ দেশ এবং বিভাগ থেকে পিছিয়ে।

পাঁচটি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার ৪টি পৌরসভা ও ১২টি উপজেলায় ৩৭৪৭.১৮ বর্গ কি.মি. আয়তনে মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাত্র ২৩১টি। অনেক গ্রামে এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। মেডিকেল কলেজ চালু হয়েছে সবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাত্র ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা একেবারেই কম। তারপরও যেগুলো আছে তার বেশির ভাগই পৌর এলাকায় বা জেলা শহরে।

বহুমুখী সংকটে হাওড়াঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষা (সূত্র: 'হাওরে শিক্ষায় হাহাকার' শিরোনামে সুনামগঞ্জ থেকে শামস শামীমের কালের কণ্ঠ প্রতিবেদন, প্রকাশিত ০৮ নভেম্বর ২০১৭)। প্রতিবেদনে সুনামগঞ্জের চিত্রটা দেখা যাক-

'জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের 'বিদ্যালয় সম্পর্কিত তথ্য' পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেলায় ১ হাজার ৪৬৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এখনো জেলার ১৬৬টি গ্রাম বিদ্যালয়হীন। বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য উপজেলা পর্যায়ের ৬১ জন সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও ৩৭ জনের পদ শূন্য। প্রায় ৬০০ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই। সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে ৩৯৩টি। ঝড়-তুফানে ভেঙে পড়ায় এবং চরম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় জেলার সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করছে। ১৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিত্যক্ত। ১২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন চরম ঝুঁকিপূর্ণ। জেলায় ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১১.৯৫ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্গম অঞ্চলে যথাসময়ে স্কুলে শিক্ষকদের (প্রায় ৭০ শতাংশ নারী শিক্ষক) পৌঁছতে না পারা। এ ছাড়া অধিকাংশ বিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষায় দ্বীপ গ্রামের এসব বিদ্যালয়ে যেতে চরম বেগ পেতে হয় শিক্ষকদের। আফালের কারণে প্রতিবছর হাওড়ে নৌকাডুবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে প্রায়ই (পূর্ব সূত্র)।'

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপাত্ত অনুযায়ী জেলায় প্রাক প্রাথমিক পাঠের সুযোগ উপযোগী বিদ্যালয়ের সংখ্যা যথেষ্ট। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই মানসম্মত না এবং বছরব্যাপী চলার অনুপযোগী। ঝরেপড়া ও সাইকেল পূর্ণতার হারের দিক থেকে সুনামগঞ্জ অনেক পিছিয়ে আছে। শিশুদের দেরিতে ভর্তি ও আগাম ঝরেপড়া এখানকার একটা খুব স্বাভাবিক চিত্র।

'শ্রাবণের আকাশে ঘন কালো মেঘ। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে। এর মধ্যে নৌকায় করে হাওড় পাড়ি দিচ্ছে কয়েকজন শিক্ষার্থী। বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়ি ফিরছে তারা' (সূত্র : প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০১৬)। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে মোশতাক আহমেদ ও খলিল রহমানের 'নৌকা না পেলে ক্লাস মিস' শিরোনামে ২২ জুলাই ২০১৬ প্রকাশিত প্রথম আলো প্রতিবেদনে একটা কেস স্টাডি :

'তাহিরপুর উপজেলায় গ্রাম ২৪৯টি। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১৩৩টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৪টি, দুটি স্কুল-কলেজ পর্যায় পর্যন্ত ও কলেজ চারটি। গ্রামগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে হওয়ায় বর্ষাকালে ঝুঁকি আর সমস্যা নিয়েই যাতায়াত করতে হয় শিক্ষার্থীদের। তাহিরপুর ছাড়াও জামালগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, ধরমপাশা, দিরাই, শালস্নাসহ বিভিন্ন উপজেলার হাজারো শিক্ষার্থীকে বর্ষাকালে এভাবে সংগ্রাম করে পড়াশোনা করতে হয়। এসব এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরাও থাকতে চান না। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তদবির করে বদলি হয়ে সুবিধামতো স্কুলে চলে যান। এ কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনাও ঠিকমতো হয় না। শিক্ষার্থীরা কতটা ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে তা দেখা গেল তাদেরই একটি নৌকায় চড়ে। ছোট এসব নৌকায় উঠলে যে কারও ভয় হবে। সামান্য বাতাসে ঢেউ উঠলেই ঝুঁকি বাড়ে। আবার বৃষ্টি নামলে বইপত্র ভিজে যায়। নৌকাতেই দেখা গেল, এক ছাত্রীর হাতে থাকা খাতা ও কাগজপত্র ভিজে একাকার। এত বৃষ্টি যে ছাতা দিয়েও রক্ষা হয়নি। তার সঙ্গে ছিল কলেজপড়ুয়া বড় বোন। বড় বোন বৃষ্টি বেগম বলেন, প্রতিদিনই এভাবে 'যুদ্ধ' করে ক্লাসে আসতে হয়। কোনো কারণে নৌকা ধরতে না পারলেই ক্লাস 'মিস' হয়। গত বৃহস্পতিবার সকালেই নৌকা যেতে দেরি হওয়ায় সকালের প্রাইভেট মিস করেছেন (পূর্ব সূত্র )।'

কারণ ও ফলাফল

সুনামগঞ্জ ভৌগোলিক দিক থেকে দেশের অপরাপর এলাকাগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, একটি হাওড় অধু্যষিত এলাকা। এটি হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল, নদী-নালা-খাল, বিস্তীর্ণ নিচু কৃষি ভূমি, সমভূমি ও নিচু ভূমির বসতভিটা এবং পাহাড়ঘেঁষা নান্দনিকতায় এক বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতি, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের সমীরণে সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এক জনপদ। মাছ, ধান, শস্য, বালু, পাথর, কয়লাসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই বিস্তীর্ণ ভুখন্ড।

কিন্তু বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যলাভের স্থাপনে এবং প্রকৃতির খেয়াল জয়ের সক্ষমতা সাধারণ জীবনধারায় পৌঁছাতে যে দূরদর্শী, সক্ষম এবং ইতিকাল ও ইম্প্যাক্ট লিডারশিপের মেলবন্ধন প্রয়োজন তার অনুপস্থিতি এখানে সবসময়ই কম-বেশি ছিল। ফলে প্রকৃতির রুক্ষতা এবং নেতৃত্ব-সৃষ্ট বঞ্চনার সমীরণ কাটিয়ে কমিউনিটির সাধারণ জনগণ তাদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কার্যকর অথবা স্থায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারেনি। হাওড়াঞ্চলে জিনি-অনুপাত বা জিনি-কোএফিসেন্ট অর্থাৎ ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এবং অভ্যন্তরীণ বা আন্তঃঅঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য অনেক বেশি। সিংহভাগ জনগণ রাজনৈতিক অর্থনীতির কৌশলগত সুবিধাবঞ্চিত এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শোষিত ও নিষ্পেষিত। ফলে এখানকার মানবোন্নয়ন সূচকের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটেনি। এমনকি এখানকার গৃহায়ণ, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সুবিধা এবং জনমানুষের পেশাসহ বেঁচে থাকার নানা অনুষঙ্গে গণ-অসচেতনতা, ভঙ্গুরতা ও প্রকৃতির কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশের ছাপ প্রখরভাবে ফুটে উঠেছে।

উপর্যুক্ত প্রেক্ষিত থেকে উদ্ভূত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো ও যাতায়াত ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা, শিক্ষা অবকাঠামো ও সুযোগের অপ্রতুলতা, দুর্বল অভিযোজন যোগ্যতা, আর্থিক অনগ্রসরতা এবং সামাজিক অসমতা আর বৈষম্যের কারণে এই অঞ্চলের শিশুরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কম। যারা ভর্তি হয় তাদের একটা বড় অংশ প্রাথমিকেই ড্রপআউট হয়ে যায় বা ঝরে পড়ে। যারা মাধ্যমিকে যায় তাদের অল্পসংখ্যক ভালো করে শিক্ষার সুযোগ পায়; ফলে উচ্চ শিক্ষার অথবা কারিগরি শিক্ষা লাভের ভিত হয় দুর্বল। মাধ্যমিক স্তরেও ঝরে পড়ার সংখ্যা পর্যাপ্ত। যারা কলেজ পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ পায় তাদের মধ্যেও উদ্যোক্তা মনোভাব ও দক্ষতা প্রান্তিক পর্যায়ে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো এবং শেখার সুযোগ-সুবিধা শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষার্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুনামগঞ্জ জেলার প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিদু্যৎ, পানীয় জল, সারা বছর খেলার উপযোগী মাঠ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেয়াল ও মেঝে এবং ভালো মানের বস্ন্যাকবোর্ডের অভাব রয়েছে। সারা বছর ব্যবহার উপযোগী পর্যাপ্ত ও পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, ছেলে ও মেয়ে শিশুদের জন্য আলাদা শৌচাগার এবং পুরুষ ও মহিলা শিক্ষকদের জন্য আলাদা শৌচাগারের অনুপস্থিতি সাধারণভাবে লক্ষণীয়। অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা সারা দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর গড় মানের কাছাকাছি হলেও বেশকিছু ক্ষেত্রে ভালো বিজ্ঞানাগারের অভাব রয়েছে এবং মাধ্যমিক স্কুল অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে দুর্গম পথ পেরিয়ে স্কুলে আসতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বর্ষা প্রতিবন্ধকতা তো আছেই।

সুপারিশ

'দুর্গম হাওড়াঞ্চলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের হাতে জমি খুব কম পাশাপাশি জলমহালগুলোও জেলেদের হাতে নেই। ফলে সেখানে জীবিকার সংকট আছে। হাওড়পাড়ের জীবনমান উন্নয়ন করতে হলে সরকারকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগিয়ে নিতে হলে সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তারা কর্মস্থলে উপস্থিত থাকলে অনেক সমস্যার দ্রম্নত সমাধান হবে।'- অধ্যাপক এম এ সালাম, ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাওড় ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক (সূত্র : প্রথম আলো, ২০২২)।

সুনামগঞ্জের শালস্না উপজেলার বাসিন্দা শিক্ষক সুব্রত দাস বলেন, 'শুকনো মৌসুমে হেঁটে আর বর্ষায় নৌকায় চলাচল করেন তারা। তার মতে, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য- সবকিছুর উন্নতি হতো (পূর্ব সূত্র)। স্থানীয় মানুষজন বলছেন, 'হাওড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগিয়ে নিতে হলে সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে থাকা নিশ্চিত করতে হবে (পূর্ব সূত্র)।'

এপ্রিল ২৫, ২০২৩ সুনামগঞ্জে অনুষ্ঠিতব্য 'হাওড় এলাকায় শিক্ষার বাস্তবতা : সুনামগঞ্জের গল্প' শীর্ষক সেমিনার ও মতবিনিময়ে সুধী জনের মুক্ত আলোচনা এবং নীতি-আলোচকদের নীতিপ্রণয়ন ও নীতিবাস্তবায়ন আলোচনার ভিত্তিতে আরও এভিডেন্স বেসড প্রায়োগিক, ইনক্লুসিভ এবং কৌশলগত সুপারিশমালা লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে।

উপসংহার

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় সুনামগঞ্জের পিছিয়ে পড়া শুধু পরিবেশগত ও প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা নয়; স্থানীয় নেতৃত্ব, বিশেষ করে সংসদ সদস্যদের নেতৃত্ব দূরদর্শিতা, ইমপ্যাক্ট লিডারশিপ সক্ষমতা এবং আবেগ-বুদ্ধিমত্তা ও নৈতিকতাও এখানে বড় প্রশ্ন।

\হহাওড় অধু্যষিত সুনামগঞ্জের শিক্ষা ক্ষেত্রে কিছু এনজিও এবং বেসরকারি উদ্যোগও লক্ষণীয়- যা প্রশংসার দাবি রাখে। তার মধ্যে ব্র্যাকের 'শিক্ষা তরী' অন্যতম। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন অনুসারে সাম্প্রতিক সময়ে (সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২) সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর থেকে 'বিজ্ঞান তরী', 'গণিত তরী' ও 'মূল্যবোধ তরী' নামের তিনটি নৌকা নিয়ে আনন্দময় শিশু শিক্ষার এক অভিনব নৌযাত্রার সূচনা করেছে ব্র্যাক (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২)। এটি আবেগ বুদ্ধিমত্তার একটি উদাহরণ।

অন্যদিকে এখানে নেতৃত্ব দূরদর্শিতা, ইমপ্যাক্ট লিডারশিপ ও আবেগ বুদ্ধিমত্তা সমীরণের একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে হাওড়ে উড়াল সেতু ও দীর্ঘ সংযোগ রাস্তা স্থাপনের উদ্যোগ, মেডিকেল কলেজ স্থাপন এবং সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইনপ্রণয়ন। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান এমপির উদ্যোগে সিলেট-সুনামগঞ্জ রেল স্থাপন উদ্যোগ এবং সুনামগঞ্জে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর স্থাপনের উদ্যোগ নেতৃত্ব দূরদর্শিতা ও ইমপ্যাক্ট লিডারশিপ সক্ষমতা এবং আবেগ-বুদ্ধিমত্তার উদাহরণ। এই ধারা হাওড়-বাঁওড়ের জনপদ পিছিয়ে পড়া সুনামগঞ্জে বিলম্বে হলেও চালু হয়েছে; উত্তরসূরি নেতৃত্বের তা অব্যাহত রাখতে হবে।

নৈতিকতার প্রশ্নটা আসে যখন আমরা দেখি হাওড় লুটপাটের চিত্র; অত্যন্ত ভঙ্গুর উন্নয়ন, যেমন- দুর্বল এবং ভঙ্গুর সাবমারসিবল রোড, রাস্তাঘাটসহ অব-কাঠামোগত উন্নয়নের স্থায়িত্বহীনতা বা অতি ভঙ্গুরতা, হাওড় সম্পদের (অর্থাৎ জলমহাল-বালু-পাথর-কয়লার) অন্যায্য-অনৈতিক বণ্টন ও চরম অব্যবস্থাপনা এবং হাওড়-বাঁধ নির্মাণ কাজে পিআইসি নিয়োগে চরম অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের ট্রেন্ডস বা দৃষ্টান্ত। এসব কাজে যদি কোনো আইনপ্রণেতার সংযোগ থাকে, তা হবে অত্যন্ত গর্হিত। এমন নেতৃত্বকে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সাহসিকতার সঙ্গে বর্জন করতে হবে।

হাওড় জনপদ সুনামগঞ্জের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাৎপর্যপূর্ণ ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে হাওড় নান্দনিকতা ও প্রতিকূলতা বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য স্থাপনে এবং এর মাধ্যমে প্রকৃতির খেয়াল জয়ের সক্ষমতা সাধারণ জীবনধারায় পৌঁছাতে সক্ষম এমন দূরদর্শী, আবেগ-বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ইতিকাল ও ইম্প্যাক্ট লিডারশিপের বিকাশ ঘটাতে হবে।

ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার : প্রাবন্ধিক, গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে