সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নদী না বাঁচলে বাঁচবে না দেশ

শুধু পুনর্খনন নয়, পুনর্খননের মান ও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে নদী আরও বেশি ভরাট হওয়ার আগে নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হোক। ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ খননে এমনিতেই বেশি সময় লেগেছে। এখন নদটি খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আর কে চৌধুরী
  ১২ মে ২০২৩, ০০:০০

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, জনজীবন, চাষাবাদ প্রায় সবই নদীনির্ভর। তাই বলা হয়, নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। অথচ বহু নদী এরই মধ্যে মরে গেছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বহু নদী হারিয়ে গেছে। পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে বহু নদীর তলদেশ। বর্তমান সরকার বদ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় দেশের ৬৪ জেলায় ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনর্খননের কর্মসূচি হাতে নেয়। অনেক নদী ও খালের খননকাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু খননের সঠিকতা নিয়ে যেমন অভিযোগ আছে, তেমনি আছে খননপরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণের অভাব।

এক সময় সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা যে বাংলা প্রকৃতির কথা বলা হয়, সেখানে নদনদীর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখন সেই নদনদীও নেই; হারিয়ে যেতে বসেছে সেই শ্যামল ও প্রশান্তির প্রকৃতিও। গোটা দেশের চিত্রই এমন। সবকটিই দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত।

নদী দূষণ ও দখল পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তা সত্ত্বেও এ দেশে এটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ও পরিবেশবাদীরা এ ব্যাপারে যতই সোচ্চার হোক না কেন কাজ হচ্ছে না। যারা পরিবেশ দূষণ করছে তারা কেবল প্রকৃতির শত্রম্নই নয়, মানুষেরও শত্রম্ন।

নগর জীবনে বেদখলকৃত নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাধার উদ্ধার ও সংরক্ষণের গুরুত্ব এখন প্রায় সবাই স্বীকার করেছেন। উপর্যুপরি জলাবদ্ধতার কারণে বিষয়টি বর্তমানে এক রকম গণদাবিতেও পরিণত হয়েছে বলা যায়। প্রকৃতিকে থমকে দিয়ে মানবসভ্যতা গতি পাবে, এ ধারণা যে কত ভুল মানুষ এখন উপলব্ধি করতে পারছে। সে জন্য সারা পৃথিবীতে চলছে নদী বাঁচাও আন্দোলন। ভারতের নর্মদা আন্দোলন থেকে নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন সবখানে চলছে নদী রক্ষা করার লড়াই। এক সময় পাশ্চাত্যেও নদী নিধন করে উন্নয়ন অব্যাহত রাখার একটা ভ্রান্ত প্রয়াস চলছিল।

এ ছাড়া নদী ভরাটের মাধ্যমে জমি দখলের মহোৎসবে অনেক প্রভাবশালীরাই জড়িত। মনে রাখতে হবে নদনদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। দূষণ এবং অবৈধ দখলের হাত থেকে নদীকে বাঁচাতেই হবে।

আরও দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো কোনো নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে অপরিকল্পিত সেতু ও কালভার্ট। শুধু সড়ক উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নদী ও জনজীবনের স্বার্থের কথা একবারের জন্যও ভেবে দেখেনি। ফলে একটি জেলায় এতগুলো নদী, যার একটিও এখন সুস্থ নেই।

মৃতপ্রায় এসব নদনদীকে বাঁচাতে নানা সময় খননসহ নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু সেসব খুব একটা কাজে আসেনি। নদীগুলো বাঁচিয়ে তোলার জন্য এখন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

\হদেশের বেশির ভাগ নদনদীর অবস্থা ভালো নেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদী মরে যাচ্ছে, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। অনেক নদী হারিয়ে গেছে। এক সময়ের খরস্রোতা নদীর বুকজুড়ে দেখা দিচ্ছে ধু ধু বালুচর। শুকনা মৌসুমে পানি নেই। বর্ষা মৌসুমে এই নদীই আবার দুই কূল ছাপিয়ে দুর্দশার কারণ হয়। বর্ষার পানি ধারণ করার ক্ষমতা নেই বেশির ভাগ নদীর। সুষ্ঠু পরিচর্যার অভাবে নাব্য হারিয়েছে অনেক নদী। এমন অনেক নদী আছে, যে নদীতে এক সময় স্টিমারসহ বড় বড় নৌকা চলত, সেসব নদী আজ হেঁটে পার হওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওত প্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা নদীর আজ খুবই করুণ দশা।

এ রকমই একটি নদ পুরনো ব্রহ্মপুত্র। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের খাগডহর, পুলিশ লাইন, কাঁচিঝুলি এলাকা, কাচারী ঘাট, জুবিলী ঘাট, কালীবাড়ীসহ বেশ কিছু এলাকায় নদের বিরাট অংশজুড়ে চর। কোথাও নালার মতো পানি বইছে। কোথাও হাঁটুপানি। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল প্রবাহ ফেরাতে নদী খনন করা হোক। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পে নদে খনন চলছে। প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী নদে শুষ্ক মৌসুমেও যেন ১০ ফুট পানি থাকে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নদটি কমপক্ষে ৯০ মিটার প্রশস্ত হবে। কাজ শেষ হলে এটি আন্তর্জাতিক নৌরুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। শুরুর দিকে কথা ছিল প্রকল্প শুরুর প্রথম দুই বছরেই খননের কাজ শেষ হবে। এরপর প্রকল্পটির দেখভাল চলবে আরো তিন বছর। এলাকাবাসীর আশা ছিল, পুরো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী দুই পাড়ের জনপদের মানুষের জীবনযাত্রায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। নৌপরিবহণ ব্যবস্থা চালু হলে এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। উন্নয়ন ঘটবে মৎস্যসম্পদের। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া অনেকটাই বন্ধ হবে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নদে চর জেগেছে। এতে হতাশ এলাকাবাসী।

শুধু পুনর্খনন নয়, পুনর্খননের মান ও পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে নদী আরও বেশি ভরাট হওয়ার আগে নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হোক। ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ খননে এমনিতেই বেশি সময় লেগেছে। এখন নদটি খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এদিকে, নদীদূষণ ও দখল এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলী হারাচ্ছে স্বাভাবিক নাব্য। নদীর পানি ধারণক্ষমতা অনেক কমে গেছে। নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় বন্যা ও জোয়ারের পানি নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত করছে। কর্ণফুলীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যেভাবেই হোক কর্ণফুলী নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। এ বিষয়ে অবিলম্বে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ দেখতে চাই। কারণ চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হলে কর্ণফুলীকে বাঁচাতেই হবে।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে