সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যের লৌহমানব বাশার আল-আসাদ

আসাদ সরকার মানবাধিকারের সম্মুখে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তিনি পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ বিরোধ, আইএস, কুর্দি ও ইসরায়েলের লবিস্টদের পরাজিত করে নিজের আসন আরব বিশ্বে সুদৃঢ় করেছেন। তবে এই প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করেই মধ্যেপ্রাচ্যের এই লৌহমানব আগামী দিনগুলোতে আরব বিশ্বে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
বিপস্নব আলী
  ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০

আরব বিশ্বের সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ২০১১ সাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এই সময় আরব বসন্তের সূত্রপাত হয়েছিল। যদিও উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের সূতিকারাগার বলা হয়, পরবর্তী সময়ে আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তার লাভ করে। আরব বিশ্বে বিভিন্ন দেশ তথা- মিশর, বাহরাইন, ইয়েমেন, লিবিয়া ও সিরিয়াতে ক্রমন্বয় রাষ্ট্রনায়কদের পতন হতে থাকে। প্রথমে তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট- এল আবেদিন বেন আলীর, মিশরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের, লিবিয়ায় মুহাম্মদ আল-গাদ্দাফি ইয়েমেনে আলী আবদুলস্নাহ সালেহের জামানার অবসান হয়। আরব বিশ্বের এই গণ-অভু্যত্থান সংঘটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের লবিস্ট হিসেবে কাজ করে চলছে। এই ধারাবাহিকতায় আরব বিশ্বে ইসরায়েলবিরোধী যে কোনো দেশের সরকার হয়তো খুব বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারে না।

তবে আরব বসন্তে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পতন হলেও সতের প্রতিকূলে শক্ত অবস্থানে রয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। যখন একের পর এক জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলন ও পশ্চিমা বিশ্বের ইন্ধনে সরকার পতন হতে থাকে তখন একমাত্র সিরিয়ার প্রসিডেন্টকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ ইরান ও পূর্ব ইউরোপের পরমাণুবিক শক্তিশালী দেশ রাশিয়া। আরব বসন্তের ফলে সিরিয়াতে যে গৃহযুদ্ধ সূচনা হয়েছিল তাতে প্রসিডন্ট বাশারব আল আসাদ বিশ্ব থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সব থেকে প্রভাবশালী সংস্থা, আরব লীগ, থেকে সিরিয়াকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এছাড়াও সিরিয়ার সেনাবাহিনী একাংশ পশ্চিমা শক্তির ইন্ধনে বাশার আল আসাদের বিপক্ষে অবস্থান করে। যা পরবর্তী ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামে বাশার আল আসাদের বিপক্ষে যুদ্ধ শুরু করেছিল। আর এই ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবসহ বেশকিছু দেশ যুদ্ধাস্ত্র ও অর্থনৈতিকভাবে সহযোগী করতে থাকে। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল দুই কোটি ২২ লাখ। সংঘাত শুরু হওয়ার পর এর অর্ধেক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচু্যত হয়েছেন, এবং আরও ৬০ লাখ মানুষ শরণার্থী বা বিদেশে আশ্রয় প্রার্থী হয়েছেন।

পিতা হাফেজ আল আসাদ ( ১৯৭০-২০০০) রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনীতিক ক্ষমতায় ত্রিশ বছর সিরিয়া শাসন করেছেন। তাই পরিবার থেকে রাজনীতি হাতেখড়ি পিতার মতো বাশার আল আসাদ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী। কীভাবে গণ-আন্দোলন পতিহত, দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিহিংসা প্রতিরোদ ও বৈদেশিক তথা পশ্চিমা বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে থাকার কৌশল তিনি খুব ভালো করে রপ্ত করেছেন। যদিও তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অনেক অভিযোগ থাকলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা করে আরব বিশ্বে আঞ্চলিক শক্তি ইরানের প্রভাব পাকাপোক্ত করেছেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দীর্ঘ একদশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকলেও এখন মধ্যেপ্র্যাচ্যে শান্তির সুবাতাস বয়ে চলছে। গত ১৯ মে আরব লিগের অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ আরব লিগে পুনরায় যোগদান করেন। এর ফলে, সিরিয়াকে আরব দেশগুলো নতুন করে গ্রহণ করেন।

মূলত গত ৬ ফেব্রম্নয়ারিতে তুরস্ক এবং উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় আঘাত হানা বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক ত্বরান্বিত হয়। সে সময় এক সময়ের শত্রম্নভাবাপন্ন দেশগুলো সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মানবিক সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবার চীন গত ১০ মার্চে এক শান্তিচুক্তিতে মধ্যস্থতা করে যাতে সৌদি আরব তার দীর্ঘদিনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনস্থাপন করে। আর সৌদি-ইরান কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে আরব বিশ্বে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্ট হয়েছে- যা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতপূর্ণ দেশগুলো সুসম্পর্কের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইরান রাশিয়ার সঙ্গে মিলে বাশার আল আসাদের বাহিনীকে সিরিয়ার বৃহত্তম শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে। তবে সিরিয়ার একটি বড় অংশ এখনো তুর্কি-সমর্থিত বিদ্রোহী, জিহাদি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি-নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া যোদ্ধাদের দখলে রয়েছে।

তবে সবকিছু উপেক্ষা করে বাশার আল আসাদ যেভাবে সিরিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকিয়ে রয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। তবে দীর্ঘদিন চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ অবসানের পথ সুগম হয়েছে। সৌদি-ইরানের কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন ও আরব বিশ্বে চীনের উপস্থিতি বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে শান্তি বয়ে চলেছে। তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ স্থায়ীভাবে অবসান হবে কিনা এই বিষয় বিবিসির রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফেরাসি কিলানি বলেন, 'একনায়ক আসাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন এক সময় নিষ্ঠুর গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়ার বেশির ভাগ এলাকা চলে যায় প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরোধী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বিরোধী গ্রম্নপগুলো বর্তমানে তুরস্কের সঙ্গে সীমান্তে খুবই ছোট্ট একটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১৭ সালে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের পতনের পর থেকে স্বশাসিত কুর্দি অঞ্চল ছাড়া বাকি সিরিয়া চলে গেছে প্রেসিডেন্ট আসাদের নিয়ন্ত্রণে। বাশার আল-আসাদকে আরব লিগে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি দেশটির বাস্তব পরিস্থিতিরই স্বীকৃতি। এর অর্থ এই নয় যে, রাতারাতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে'। তবে আমার মনে হয়, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার শেষ পান্থে রয়েছে। কেননা, আরব বিশ্বে প্রতিনিধিত্ব দেশ সৌদি আরব এখন পশ্চিমা শক্তিকে প্রায় উপেক্ষা করে চীন ও রাশিয়া বলয়ের পথে ধাবিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সিরিয়াকে আরব লিগে পুনরায় আন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েল- যা আরব বিশ্বে ক্যানসার নামে পরিচিত অনেকটাই ব্যাকফুটে পড়েছে। কেননা, যখন মধ্যেপ্রাচ্যের বিবাদমান দেশগুলো যথা- ইরান, সৌদি আরব, সিরিয়া ও ইয়েমেন ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে তখন তেল-আবিব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপক্ষে অবস্থান করে চলেছে। আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে ইসরায়েল নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে এই ভেবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার আরব লিগে যোগদানের কট্টর সমালোচনা করেছেন। এছাড়াও পশ্চিমা দেশগুলোর বারবার মানবাধিকার প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে। তবে আসাদ সরকার মানবাধিকারের সম্মুখে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তিনি আরব বসন্ত পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ বিরোধ, আইএস, কুর্দি ও ইসরায়েলের লবিস্টদের পরাজিত করে নিজের আসন আরব বিশ্বে সুদৃঢ় করেছেন। তবে এই প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করেই মধ্যেপ্রাচ্যের এই লৌহমানব আগামী দিনগুলোতে আরব বিশ্বে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

বিপস্নব আলী : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে