সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ জাপান সম্পর্ক

বাংলাদেশের আয়তন ছোট ও প্রাকৃতিক সম্পদ কম; তাই জাপানের সহযোগিতায় সামুদ্রিক সম্ভাবনার সন্ধান করতে হবে। সরকারের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনাকে স্বাগত জানাই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সঠিক বন্ধু নির্বাচন আর দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শূন্যতা দূরীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাতাসে গর্ত হলে আশপাশের বাতাস এসে দ্রম্নত শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়েই ঝড়ের সৃষ্টি হয়। রাজনীতির শূন্যস্থান পূরণে যে অঘটন ঘটে, সেখানে দেশ পিছিয়ে পড়ে মারাত্মকভাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের উন্নয়ন টেকসই হবেই।
মো. মাহবুবুর রহমান
  ২৭ মে ২০২৩, ০০:০০

২০২২ সালে জাপান ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ৫০ বছর (সুবর্ণজয়ন্তী) পার হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম জাপানি ওডিএ প্রাপকদের মধ্যে একটি। ২০২২ সালের ২৮ জুন দুটি প্রকল্পের জন্য ১৬৫,৮৬১ মিলিয়ন ইয়েন ওডিএ সহযোগিতা স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাঁচ দশকের দীর্ঘ যাত্রার শক্তি, সমস্যা এবং সম্ভাবনা এসব মূল্যায়নে একটি অব্যক্ত চেতনার প্রলেপ আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণের পর টোকিও ট্রায়ালে জাপানি নেতাদের বিচারের জন্য গঠিত বিচারপতি প্যানেলে একমাত্র বাঙালি বিচারপতি ভয়ডরহীনভাবে জাপানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১. অতীতের সেই কৃতজ্ঞতার কিছু অংশে জাপানের হৃদয়ে বাংলাদেশ আজও জড়িয়ে আছে। ২. বর্তমানে জাপানের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।

জাপানের সাধারণ জনগণ রাজনীতি নিয়ে তেমন কিছু ভাবে না। রাজনৈতিক নেতারা তাই জনগণের আবেগকে সম্মান করেন। জাতীয় অনুভূতি বলে একটি ব্যাপার আছে। জাপানের হাইস্কুলের ইতিহাস বিষয়ের টেক্সটবুক 'শোছেতছু নিহোনশি' ৩৪৯নং পৃষ্ঠা এবং আরেকটি টেক্সটবুক 'শিন নিহোনশি' ৩৫৯নং পৃষ্ঠায় বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল সম্পর্কে লেখা আছে। নেতারা তো এসব বই পড়েই শিক্ষিত হয়েছেন। তবে তারা এ সমস্ত অবদানকে একজন ভারতীয় বিচারকের অবদান হিসেবে জানেন। যদিও তার জন্ম, বেড়ে উঠা শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশেই। তবুও ১৯৪৭-এর আগে জন্ম এবং কলিকাতা হাইকোর্টে বিচারিক জীবন এসব তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করে ইন্দো-জাপান ফ্রেন্ডশিপসহ যেখানে যে সুবিধা নেয়া যায়, তার সবটুকু নেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া খুব দক্ষ। সম্ভাব্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সুবিধা আদায়ে সচেষ্ট। যেমন, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো মহাসচিব জাপান নাগরিক কইচিরো মাতসুরা ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছিলেন। এখন জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে বাংলা গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গেও জোরেশোরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। জানি না, আমাদের কূটনীতিবিদরা এসব বিষয়ে কতটুকু চৌকষ। 'বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল' নামের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করে জাপানকে প্রভাবিত করার সেই যোগ্য লোক কী এখন আছেন? একজন ছিলেন। জোর করে এনে দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জোর করে নিজের প্রভাব খাটিয়ে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা কাজী নজরুল ইসলামকে ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মিয়ানমারের সঙ্গে সামান্য একটু সীমান্ত। একদিকে বঙ্গোপসাগর আর তিন দিকে ভারত। এক কথায় ভারতের পেটের ভেতরে বসে ভাবতে হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবকিছু। কাজটি মোটেও সহজ নয়। এরকম ভৌগলিক সুযোগ পেলেই বড় দেশগুলো চোরা পথে তার উচ্ছিষ্ট জিনিস পাঠায় আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যায়। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে ভারত রেগে যায়। চীন, ভারত দুটোকে বাদ দিয়ে জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চাইলে আমেরিকার সবকিছুকে হঁ্যা বলতে হবে। তা না হলে আমেরিকার চাপে জাপান বিগড়ে যায়। জাপান আমেরিকার কথা শুনতে বাধ্য। উপসাগর যুদ্ধের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মিত্রশক্তি গঠনে সবার আগে সৈন্য পাঠিয়েছিল সেনাবাহিনীবিহীন নিরীহ জাপান। প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানের চারিদিকে আমেরিকার ভাসমান প্রহরা এ কথা সবাই জানে। বাংলাদেশের সাম্প্র্রতিক রাজনীতিতে জাপান দূতাবাসের বক্তব্য ওইরকম একটি বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরের তারিখ পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক আছে বলে জাপানের রাজনৈতিক মহল মনে করে না।

ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন বিষয়ে সমগ্র দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পরাশক্তিগুলো মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ার মতো বিরল ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। আয়তনে ছোট আর প্রাকৃতিক সম্পদ কম থাকলেও বাংলাদেশের আছে একটি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। বাংলাদেশকে এখন সবার প্রয়োজন। ভারত মহাসাগরকে কেন্দ্র করে শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভারত, চীন, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান সামুদ্রিক শক্তিগুলোর কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ট্রানজিট পয়েন্ট। চীন এবং ইন্ডিয়া তীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাই হিমালয়ের পাদদেশে থাকা নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন ও ভারতের কাছেও বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিকেশন হাব। বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র। এই অবস্থায় অপেক্ষাকৃত কম স্বার্থান্বেষী বন্ধু বাছাই করা জরুরি।

পৃথিবীতে এক্সেস অব টেকনোলজি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চীনকে কোনো কাজ দিয়ে টেকনোলজি পাওয়া সম্ভব নয়। জাপান সেক্ষেত্রে কিছুটা ভালো। বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা জাপানকে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে শুধু কন্ট্রাক্ট দিলেই চলবে না; ওদের কাছ থেকে অপারেশন পরিচালনার টেকনোলজি শিখে নিতে পারলে দেশের সব বিমানবন্দর ভালোভাবে পরিচালনা করা যাবে। এখনো বিদেশিরা দ্রম্নত ইমিগ্রেশন পার হতে পারলেও বেল্টে ব্যাগ দিতে অনেক দেরি হয়। টোকিও-ঢাকা সরাসরি বিমান পরিচালনায় অতি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাপানি বিনিয়োগকারীদের এয়ারপোর্ট বিড়ম্বনা দূর করা জরুরি। টোকিও শহরে ইয়ামানোতে লাইন ট্রেনটি বৃত্তাকারে পুরো শহরটিকে প্রদক্ষিণ করে। ভোর ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। ২ থেকে ৫ মিনিট পর পর ট্রেন এসে দাঁড়ায়। ওই আদলে জাপানের সহযোগিতায় ঢাকায় ট্রেন পরিচালনা করতে পারলে কর্মক্ষেত্রে সঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে সবাই। গাড়ি বাসায় রেখে মানুষ ট্রেনে করে অফিসে যাবে।

বাংলাদেশের আয়তন ছোট ও প্রাকৃতিক সম্পদ কম; তাই জাপানের সহযোগিতায় সামুদ্রিক সম্ভাবনার সন্ধান করতে হবে। সরকারের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ পরিকল্পনাকে স্বাগত জানাই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সঠিক বন্ধু নির্বাচন আর দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শূন্যতা দূরীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাতাসে গর্ত হলে আশপাশের বাতাস এসে দ্রম্নত শূন্যস্থান পূরণ করতে গিয়েই ঝড়ের সৃষ্টি হয়। রাজনীতির শূন্যস্থান পূরণে যে অঘটন ঘটে, সেখানে দেশ পিছিয়ে পড়ে মারাত্মকভাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের উন্নয়ন টেকসই হবেই।

মো. মাহবুবুর রহমান : সাবেক রাকসু নেতা (১৯৮৯), হাইকোর্টের সাবেক আইনজীবী, বর্তমানে জাপানে কর্মরত

সধযনঁংরহভড়@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে