সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার লক্ষ্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট শাহ

বাংলাদেশ সরকারের উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ১৯৭২ সালের সংবিধান মোতাবেক দেশ পরিচালনা এবং শিক্ষা ব্যবস্থাটা কুদরতে খোদার শিক্ষা কমিশনের নির্দেশে পরিচালনা করা। নইলে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশের আর্থিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
মো. জিয়াউদ্দিন
  ২৭ মে ২০২৩, ০০:০০

১৯৪৭ সালে তথাকথিত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নেয় দুটি রাষ্ট্র। একটি ভারত অন্যটি পাকিস্তান। উপমহাদেশ ভাগের সময় অসংখ্য ধর্ম বর্ণ নিয়েই ভারত স্বাধীন হয়। তবে পাকিস্তান নামক দেশটি সৃষ্টি হয় মুসলমান ধর্মপালনকারী জনসংখ্যার আধিক্যের ভিত্তিতে; তাই ১৯৪৭ সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পায় পরিচিতি। পূর্র্ব বাংলায় মুসলিম ধর্মপালকারী বাঙালিরা সংখ্যায় অধিক থাকায় পূর্র্ব বাংলা অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। বাঙালি মুসলিম ধর্মপালনকারীরা পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেই ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের সময় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই পূর্র্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তান সৃষ্টির মূলনীতিগুলোর সঙ্গে পূর্র্ব বাংলার সার্বজনীন নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সমাজ সংস্কৃতির প্রথা ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিকতা অনুভব করতে থাকে। ১৯৭০ সালে এসে পূর্র্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের মুসলিম ধর্মীয় সত্ত্বার চেয়ে বাঙালি সত্ত্বাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। পূর্র্ব পাকিস্তানের জনগণের ধর্মীয় সত্ত্বার চেয়ে বাঙালি পরিচয়কে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো, পাকিস্তানিরা বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছে বারবার। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য, ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়। বাঙালি সংস্কৃতির প্রথাগুলো পালনের ক্ষেত্রে পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়ে উঠে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। ধর্ম নামক বিষয়টিকে তারা হাতিয়ার করে নানা ধরনের নিষ্পেষণ ও নিপীড়ন চালায় নিরীহ বাঙালিদের ওপর। যেমন উর্দুতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, রাষ্ট্রীয় সব কর্মকান্ড ধর্মের নামে পালন করা, রবিন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা, বাংলা জনপদের কৃষ্টি ও কালচারকে অবদমন করার লক্ষ্যে ধর্মীয় নিয়মে পাকিস্তানি কৃষ্টি পালনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। পাকিস্তান এ ধরনের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয়ভাবে চলত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই মূলনীতি নিয়ে ১৯৬০ সালের দিকে সংগঠিত হতে থাকে। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম সমাজ পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মীয় নীতির তীব্র বিরোধিতা করে। পূর্ব বাংলায় জনপদে অসংখ্য ধর্ম বর্ণের মানুষের বাস। কিন্তু পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার পর এককভাবে মুসলিম জাতিকে প্রধান নিয়ামক সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলা জনপদের ঐতিহ্যগত প্রথা ও সংস্কৃতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অবজ্ঞা করতে শুরু করে। এই ধরনের অবজ্ঞার বিরোধিতা করেই বিদ্রোহ দানা বাঁধে বাংলা জনপদে। ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। মুক্তিযোদ্ধের মূল চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক, সাম্য সমতার, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তা সুষ্পষ্ট হয়ে উঠে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে যা বুঝা যায় তা মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সদ্য প্রয়াত চলচিত্র অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের একটি উক্তি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, তিনি বলেছেন, 'আমরা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি, আমরা যুদ্ধ করেছি এই দেশ স্বাধীন করার জন্য, পরাধীনতার যে শেকল মানুষের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটাকে ভেঙেচুরে ৩০ লাখ মানুষের বুকের রক্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে'। বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া তাতে বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করলে ভুল হবে না। এ দেশের নারীরা পোশাক পরিচ্ছেদে দু'ভাগে বিভক্ত। একটি মুসলিম ধর্মের নারী, অন্যটি হলো যে সব ধর্ম আছে সেই সব ধর্মের। বাংলাদেশে বাঙালি জনসংখ্যার ৮৫ ভাগই মুসলিম ধর্ম পালনকারী। মুসলিম ধর্মপালনকারী পরিবারগুলোর ৯৫ ভাগ নারী এখন পাকিস্তানি স্টাইলে হিজাব পরিধান করে। যে সব বাঙালি মুসলিম ধর্ম পালনকারী পরিবারের নারীরা হিজাব পরে না, বাঙালির আদি ঐতিহ্য শাড়ি পড়ে ঘর থেকে বের হয়, তাদের শুনতে হয় নানা ধরনের কু-কথা। তাছাড়া, কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোনো মুসলিম নারী হিজাববিহীন গেলে তাকে সহকর্মীরারা নানা ধরনের কথা বলে থাকেন। বাংলাদেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠান দৈন্দিন কাজকর্ম ১টার পর নামাজ ও খাবারের বিরতির জন্য বন্ধ থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আবার তাদের কাজ শুরু করে বিকাল ৩টায়। সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এটি অঘোষিত একটি নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হয় ধর্মীয় কায়দায়। মিলাদ- মাহফিল, হাম-নাদ ও দোয়া মোনাজাতের মধ্য দিয়ে পালিত হয় জাতীয় দিবসের কর্মকান্ড। জাতীয় দিবসগুলোর প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হয় না। সব ব্যাংকেই লেখা থাকে তারা ইসলামিক শরিয়া মোতাবেক পরিচালিত। শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্য সূচি এবং সিলেবাসে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা ইসলামিক তরিকা মোতাবেক। মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য এবং বিষয় বস্তুর সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। দেশে দিন দিন বাড়ছে কওমি ও আরবি মাদ্রাসা। মাদ্রাসা এবং কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা জনপদের, কৃষ্টি কালচার, প্রথা ও সংস্কৃতিকে বলা হয় হিন্দুয়ানি, তাই মুসলিমদের এটা পালন করা ঠিক না। অথচ পাকিস্তানের সময়েও বাঙালি হিন্দু-মুসলিমদের মাঝে সংস্কৃতিগত কোনো পার্থক্য ছিল না, বর্তমানে ধর্মের নামে এই পার্থক্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশ ইসলামিক রাষ্ট্রের রূপ নিলে অবাক হওয়ার মতো কিছু ঘটবে না। প্রতিটি বিভাগীয় সদরে, জেলা সদরে ও উপজেলা গড়ে তোলা হচ্ছে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার ও মডেল মসজিদ। অথচ বাংলাদেশ মূলত স্বাধীন হয়েছিল তার সংস্কৃতি ওপর পাকিস্তানিদের অবদমনের হাত থেকে রক্ষার পাওয়ার জন্য। ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই পাকিস্তান বিরোধী জনমত গড়ে উঠে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর কেন এই চিত্র? ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এ দেশের মসনদে স্বৈরাচারী সেনা শাসকরা ক্ষমতায় বসেন। তারা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের জনমত সৃষ্টি করে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর গণতান্ত্রিক ধারায়ও রাজনীতিতে ধর্মকে লালন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্স্নো-পয়জনিংয়ে মানুষের মনোজগতে ধর্মকে প্রবেশ করানো হয়েছে। বর্তমানে এই স্স্নো-পয়জন হয়ে গেছে বিশাল বৃষ বৃক্ষ। কোনো রাজনৈতিকগোষ্ঠিই এর বাইরে যেতে পারছে না। দেশের অনেক রাজনৈতিক দল জামায়াত শিবিরের বিরোধিতা করে। বর্তমান সরকার জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে সর্বস্তরে জামায়াত তার রাজনৈতিক আর্দশ প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে।

আজকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা সংকটাপন্ন। এই সংকটাপন্ন হওয়ার মূল কারণ মৌলবাদী রাজনীতি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও তাদের আর্থিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক খারাপ। যে কোনো দেশেই মৌলবাদী রাজনীতি চর্চায় সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবহত হয়। মৌলবাদ শুধু একটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় ধরে রাখতে পারে সমগ্র জাতির কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে দিকে তাকালেই বুঝা যায়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারতে অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে ধস।

বাংলাদেশ সরকারের উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ১৯৭২ সালের সংবিধান মোতাবেক দেশ পরিচালনা এবং শিক্ষা ব্যবস্থাটা কুদরতে খোদার শিক্ষা কমিশনের নির্দেশে পরিচালনা করা। নইলে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশের আর্থিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে