সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষকের মর্যাদা

নতুনধারা
  ২৮ মে ২০২৩, ০০:০০

'শিক্ষক' সমাজে মানুষ তৈরির কারিগর একইসঙ্গে জ্ঞানের ফেরিওয়ালা হিসেবে বিবেচিত। একটি দেশ কিংবা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবেও শিক্ষকদের বিবেচনা করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সর্বস্তরের কর্মচারীরা কোনো না কোনো শিক্ষক থেকে দীক্ষা নিয়েছেন। তাই শিক্ষক পেশাটি সর্বজনবিদিত সম্মানিত পেশা। শিক্ষকরা একটা সমাজকে ঘোর অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দিতে সক্ষম। তাই তো কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তার অমোঘ কবিতা 'শিক্ষাগুরুর মর্যাদা'-তে দিলিস্নর বাদশাহ পুত্র ও তার শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার ঘটনাটি উদাহরণ হিসেবে টেনে এনেছেন। যেখানে শাহজাদা শিক্ষকের পা না ধুয়ে দিয়ে শুধু পানি ঢালার দরুণ বাদশাহর ক্রোধান্বিত হওয়ার যে ব্যাপারটি, সেখানে বাদশাহ শিক্ষকের কতটুকু মর্যাদা দিয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা সময়ে শিক্ষকদের দেখে ভয়ে হাড়কাঁপুনির ইতিহাস থাকলেও বর্তমানে দিন যত গড়িয়ে যাচ্ছে, ততই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের টানাপড়েন প্রকট আকার ধারণ করছে, একই সঙ্গে শিক্ষকদের মর্যাদা শিক্ষার্থীদের দ্বারা এতটাই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, আজকাল প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগরখ্যাত জাতির আলোকবর্তিকাবাহী শিক্ষকরা। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বহির্বিশ্বেও শিক্ষকদের যথার্থ সম্মান দেওয়ার প্রবণতা ক্ষীয়মাণ হচ্ছে। 'গেস্নাবাল টিচার্স ইনডেক্স- ২০১৮'-এর জরিপে দেখা গিয়েছে পৃথিবীব্যাপী গড়ে মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সম্মান দেয়। একটি জাতিকে বদলাতে শিক্ষকদের ভূমিকা অতুলনীয়, অপূরণীয় একইসঙ্গে অনস্বীকার্যও বটে। এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, 'তিনজনই পারেন একটি জাতিকে বদলাতে তারা হলেন- মা, বাবা ও শিক্ষক।' বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ভাষায়, 'সৃষ্টিশীল প্রকাশ এবং জ্ঞানের মধ্যে আনন্দ জাগ্রত করা হলো শিক্ষকের প্রধান শিল্প।' ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম ধর্মসহ সব ধর্মেই শিক্ষকদের সম্মানের আসনে আসীন করা হয়েছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব- শিষ্টাচার শিখো এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো' (আল-মুজামুল আওসাত, হাদিস নং : ৬১৮৪)। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক শিক্ষা, অন্তত শিক্ষকদের যথার্থ সম্মান করার বোধোদয় যদি কারও না হয়, পৃথিবীতে সে যত বড় কিছুই হোক আসলে সে মানুষ হতে পারেনি এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- বর্তমানে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার ঘটনা অহরহ। সম্প্রতি কুমিলস্না জেলার চান্দিনা উপজেলার একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নকল করতে না দেওয়ায় ইট দিয়ে শিক্ষকের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। যা থেকে বর্তমান শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার মানদন্ড কিছুটা হলেও অনুমেয়। সেই সঙ্গে সম্মুখে মারাত্মক বেয়াদবির ব্যাপারগুলো বর্তমানে তো অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনাই বটে। আবার এর বিপরীত দিকটা দেখাও অতীব জরুরি। বর্তমানে একশ্রেণির তথাকথিত শিক্ষক তৈরি হচ্ছেন যাদের কর্মকান্ড আসলে 'শিক্ষক' শব্দটার সঙ্গে যায় না। যারা নিজেই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন, অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব যদি তাদের ওপর বর্তায় তাহলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের দীক্ষা দেওয়া তো দূরের কথা বরং তারা 'শিক্ষক' নামের পেশাটাকে কলুষিত করে ফেলেন। সম্প্রতি রংপুর জেলার কারমাইকেল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী ও শিক্ষকের অশ্লীল ভিডিও কথোপকথন ভাইরাল এবং সমসাময়িক এরকম অহরহ ঘটনা বিদ্যমান। একটা সময়ে শিক্ষককে বাবার আসনে রাখা হলেও বর্তমানে ছাত্রী-শিক্ষক কুরুচিপূর্ণ এবং অশালীন অবৈধ সম্পর্ক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই কর্মকান্ডগুলো এসব তথাকথিত শিক্ষক নামের অশিক্ষিতদের অমানুষের পর্যায়কে উন্নীত করতে যথেষ্ট। কেননা, প্রখ্যাত দার্শনিক এবং বুদ্ধিজীবী ড. সর্বপলস্নী রাধা কৃষ্ণোয়ণের ভাষ্যমতে, 'সত্যিকারের শিক্ষক তারাই যারা আমাদের ভাবতে সহায়তা করে।' তাই একদিকে শিক্ষার্থীদের যেমন পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষকদের যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে নৈতিকতার শিক্ষা অর্জন আবশ্যক, অন্যদিকে সেই নৈতিকতা শেখানোর জন্য নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষকের বিকল্প নেই। তবেই একটি আদর্শ সমাজ তথা রাষ্ট্র বিনির্মাণ সহজতর হবে একই সঙ্গে জাতির আলোর দিশারী সম্মানিত শিক্ষকদের পুরনো মর্যাদা ফিরে আসবে।

আবু আখের সৈকত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে