রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির-(ইউএনডিপি) 'দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ' সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত ঝুঁকির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে শীর্ষে দেখানো হয়েছে। আর তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনার পাশাপাশি বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধন রোধ, কার্বন নিঃসরণ রোধ, শিল্পদূষণ রোধ, পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। তাছাড়া জনসেচতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণরোধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
অমল বড়ুয়া
  ২৯ মে ২০২৩, ০০:০০

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কুপ্রভাবে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের মন্দ প্রভাবের ঝুঁকিতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি। আর দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে প্রকাশিত 'বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০২১ শীর্ষক' প্রতিবেদন মতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ১৮০টি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন বন্যা, খরা, সামুদ্রিক ঝড়, ভূমিধস এবং দাবানলের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। এর ফলে বাড়িঘর, জমি, খামার, ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষতির মতো অর্থনৈতিক ক্ষতিতে পড়বে বাংলাদেশ। এছাড়াও অন্যান্য যেসব ক্ষতির মুখে পড়বে তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো মানুষের মৃতু্য, সাংস্কৃতিক এলাকা বা প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের মতো বিষয়গুলোও। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা এগিয়েছে। প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের নাম শীর্ষে থাকার অন্যতম কারণ ছিল ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৫ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা প্রভৃতি। আবার পরবর্তী প্রতিবেদনে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও ফণির নামও এসেছে। জার্মানওয়াচ-এর প্রতিবেদন মতে গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি সব দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং হচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক বেশি।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০১৮ সাল ছাড়া গত ছয় বছর নিয়মিত বড় বন্যা হয়েছে, যেগুলো ১০ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে। বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। হাওর এলাকায় আকস্মিক বন্যা, বজ্রপাত বাড়ছে। বিভিন্ন নগরে বন্যা হচ্ছে, অতি বৃষ্টিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরের মতো মহানগরগুলো ডুবছে, ঘটছে ভূমিধসের ঘটনা। আবার দক্ষিণাঞ্চলে পানি স্বল্পতার কারণে খরা পরিস্থিতি হয়েছে; হিটওয়েভ দেখা যাচ্ছে, হিটশক ঘটছে কৃষিতে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে, জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সুন্দরবন হুমকিতে রয়েছে। সেইভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের তথ্যমতে, ২০২১ সালের মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৬ মাসে বজ্রপাতে ২৩১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এই সময়ের মধ্যে আহত হয়েছে ৬৪ জন। দেশের পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ বাংলাদেশে দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এতদিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকটে পড়তে দেখা যায়নি। তবে এখন অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশে একের পর এক বিপদ টের পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০ সালে প্রকাশিত গেস্নাবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম প্রথম অবস্থানে উঠে এসেছিল। এই প্রতিষ্ঠানের ২০০৭ এবং ২০০৮ সালের প্রতিবেদনেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকরা বাংলাদেশকে 'পোস্টার চাইল্ড' হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।

\হবৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত-২০২২ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে- বিশ্বের তাপমাত্রা এখন প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চাইতে ১ দশমিক ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে গেছে এবং গত আট বছর ছিল রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীর উষ্ণতম বছর। ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য দরিদ্রতর দেশগুলোকে বছরে ১০,০০০ কোটি ডলার দিতে রাজি হয়েছে। মূলত দুটি ক্ষেত্রে এ সহায়তা দেয়া হবে। একটি হলো মিটিগেশন বা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো, আরেকটি হচ্ছে অ্যাডাপ্টেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য নেয়া পদক্ষেপ। গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরগোষ্ঠী 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ কোলাবোরেশন' তাদের এক নতুন রিপোর্টে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বিপদাপন্ন ৫৫টি দেশে ইতোমধ্যেই (২০০০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত) যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ হচ্ছে ৫০,০০০ কোটি ডলারেরও বেশি। আগামী দশকে এ ক্ষতি আরও ৫০,০০০ কোটি ডলার বেড়ে যাবে। রিপোর্টটির প্রণেতারা বলছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা এক ভগ্নাংশ পরিমাণ বাড়ার অর্থ হচ্ছে আরো ক্ষতি; আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য- ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির পরিমাণ হবে ২৯,০০০ কোটি ডলার থেকে ৫৮,০০০ কোটি ডলার পর্যন্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সালে নাগাদ খরায় উদ্বাস্তু হবে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এ রকম আকস্মিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের প্রায় ৮ শতাংশেরও বেশি নিম্নাঞ্চল ও পস্নাবনভূমি আংশিক অথবা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়বে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত তালিকায় বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। অনেকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বন্যায় উদ্বাস্তু হবে প্রায় ৭ কোটি মানুষ। ইউনেসকোর 'জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ' শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থান অধিকারী দেশ। মাছ চাষের ক্ষেত্রে এ দেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশ বছরে ৩,০০০ কোটি টাকার মাছ রপ্তানি করে। এ দেশের জাতীয় আয়ের ৩ দশমিক ৭০ ভাগ এবং রপ্তানি আয়ের ৪ দশমিক ০৪ ভাগ আসে মৎস্য খাত থেকে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে এই মৎস্য খাতের ওপর পড়ছে বড় প্রভাব।

আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন (এজিইউ)-এর মতে, আন্টার্কটিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে চওড়া হিমবাহটির পুরোটাই গলে যাবে। তার ফলে, মহাসাগরের পানির স্তর উঠে আসবে দুই ফুটেরও বেশি। বিজ্ঞানীরা এই হিমবাহটির নাম দিয়েছেন 'ডুম্‌?সডে গেস্নসিয়ার'। পৃথিবীর সবচেয়ে চওড়া এই হিমবাহটির দৈর্ঘ্য ৮০ মাইল বা ১২০ কিলোমিটার আর গভীরতা দুই হাজার ৬০০ থেকে তিন হাজার ৯০০ ফুট বা ৮০০ থেকে ১২০০ মিটার। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার আট ভাগের একভাগ। এর ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের মতো উপকূলবর্তী দেশসমূহের বিশাল অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার কমিটি বা আইপিসিসি'র এক গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন যে চরম তাপপ্রবাহ, ভারী বৃষ্টিপাত, খরা বা সাইক্লোন হতে দেখা যাচ্ছে, তাতে জলবায়ুর এই পরিবর্তন স্পষ্ট ফুটে উঠছে। শিল্পযুগের আগে পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা যা ছিল, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সেই তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্রাফ্‌?ট-এর তালিকায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির-(ইউএনডিপি) 'দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ' সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত ঝুঁকির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে শীর্ষে দেখানো হয়েছে। আর তাই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনার পাশাপাশি বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধন রোধ, কার্বন নিঃসরণ রোধ, শিল্পদূষণ রোধ, পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। তাছাড়া জনসেচতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণরোধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।

অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে