সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

জলাতঙ্ক :যে সচেতনতা জরুরি

আখলাক ই রাসুল
  ০২ জুন ২০২৩, ০০:০০

পানির শব্দ, পানি দেখে বা পানির কথা মনে পড়লে প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বলে এই রোগের নাম 'হাইড্রোফোবিয়া' বা জলাতঙ্ক। অবশ্য এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং মৃতু্যর হার প্রায় শতভাগ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি ১০ মিনিটে একজন এবং প্রতি বছর প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ জলাতঙ্ক রোগে মারা যান। বাংলাদেশেও বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী মৃতু্যবরণ করেন জলাতঙ্কে। শুধু মানুষই নয়, প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার গবাদিপশুও জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে থাকে দেশে। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর উন্নত দেশসহ অধিকাংশ দেশ এ রোগের সংক্রমণ সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখনো পৃথিবীর প্রায় শতাধিক দেশে এ রোগ বিরাজমান এবং বছরে প্রায় ৫৯০০০ হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করে। আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশ বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। বৈজ্ঞানিক লুইপাস্তুর সর্ব প্রথম ১৮৮৪ সালে জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেন। অনাগত ভবিষ্যতে কোটি কোটি মানুষ বা প্রাণীর জীবন রক্ষার উপায় উদ্ভাবন করে বিশ্বমানবতার জন্য এক অনন্য কল্যাণ সাধন করেছিলেন। এ মহা মনীষীর স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে প্রতি বছর তার মৃতু্যর তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য, মরণব্যাধি জলাতঙ্ক রোগ-প্রতিরোধে, দেশ বা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। রোগটি প্রতিরোধের লক্ষ্যে মানুষকে সচেতন করতেই গেস্নাবাল অ্যালায়েন্স ফরর্ যাবিস কন্ট্রোলের উদ্যোগে প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলাতঙ্ক দিবস পালিত হয়। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক- এই মরণব্যাধি জলাতঙ্কের আদ্যোপান্ত, এটি সাধারণত প্রাণীবাহিতর্ যাবিস ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। এশিয়া মহাদেশে কুকুরই প্রধান বাহক, যা এই রোগটি ছড়ায়। এছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বিড়াল, পাতিশিয়াল, শিয়াল, ভোদড়জাতীয় প্রাণী, ভালুকজাতীয় প্রাণী, নেকড়ে বা বেজির মধ্যেও এ ভাইরাসটি থাকে। প্রাণী জলাতঙ্ক সৃষ্টিকারী ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এবং আক্রান্ত প্রাণীটি সুস্থ মানুষ বা গবাদিপশুকে কামড়ালে ওই মানুষ কিংবা গবাদিপশুও এ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে আমাদের দেশে অধিকাংশ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুর, বিড়ালের কামড়ে এবং কুকুরে কামড়ানো ব্যক্তির ৪০ শতাংশই হলো ১৫ বছরের কম বয়সি শিশু। আক্রান্ত প্রাণীর মুখের লালায় জলাতঙ্কের ভাইরাস থাকে। ভাইরাস বহনকারী এই লালা সুস্থ ব্যক্তির শরীরে পুরনো ক্ষতের বা দাঁত বসিয়ে দেওয়া ক্ষতের মাধ্যমে কিংবা সামান্য আঁচড়ের মাধ্যমে রক্তের সংস্পর্শে এলে বা অতি দুর্লভ ক্ষেত্রে আক্রান্ত প্রাণীর লালা থেকে সৃষ্ট অ্যারোসল বাতাসের মাধ্যমে সুস্থ ব্যক্তির ফুসফুসে প্রবেশ করলের্ যাবিস ভাইরাস ধীরে ধীরে প্রান্তীয় স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায়। ফলে গলবিল এবং খাদ্যনালির মাংসপেশির কাজ নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুও আক্রান্ত হয়। সাধারণত আক্রান্ত প্রাণী সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ানোর পাঁচ-ছয় দিন থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত শরীরে সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কামড় দেওয়ার পর ২০-৬০ দিন পর উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

লক্ষণসমূহ :শুধু পানির প্রতি আতঙ্কই নয়, জলাতঙ্কে আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণেও কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। যেমন-১। রোগটি শুরু হওয়ার দুই-চার দিন আগে মনে হবে সুচ বা পিন দিয়ে কেউ শরীরে আঘাত করছে। ২। ব্যথা অনুভব হবে এবং শরীর চুলকাবে। বিশেষ করে কামড়ের স্থানে এবং এটা স্নায়ু দ্বারা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়াবে। ৩। স্পাস্টিক বা অতিমাত্রায় অস্থিরতা : হঠাৎ করে মানসিক পরিবর্তন যেমন- স্পর্শ করলেই লাফ দিয়ে ওঠা, ভয় পাওয়া, শব্দ শুনলে বা দেখলে অস্থির বা চিৎকার দিয়ে ওঠা, মেজাজ খিটখিটে, স্তব্ধতা, চুপচাপ, অবসাদ, জ্বরজ্বর ভাব হবে। এছাড়া ক্ষুধামন্দা, খাওয়া-দাওয়ায় অরুচি, বিকৃত আওয়াজ, কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া। ৪। মুখের ভেতরে, গলায় শ্বাসনালি, খাদ্যনালি সংকোচন হয়। ফলে হাইড্রোফবিয়া হবে,পানি পান করতে পারবে না। এছাড়া খাবার খেতেও আক্রান্ত ব্যক্তির কষ্ট হয় এবং খিঁচুনিসহ মুখ থেকে অতিরিক্ত লালা নি.সৃত হবে। ৫। ডিমেনশিয়া : রোগী পাগলের মতো ছটফট করবে। অস্থির হবে, ভাঙচুর করবে, ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলবে। এরপর অজ্ঞান হয়ে যাবে। ৬। বিনা প্ররোচনায় অন্যকে আক্রমণ বা কামড় দেওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি কিছু লক্ষণ প্রকাশ করতে পারেন। ৭। শ্বাসকষ্ট : শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু ও মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। ৮। প্যারালাইটিক বা অবশ হয়ে যাওয়া : রোগ হওয়ার ৭ থেকে ১০ দিন পর এ অবস্থা হবে। এ অবস্থা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগী মারা যাবে। সাধারণত লক্ষণ দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগী মারা যান। কোনো অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না। ফলে জলাতঙ্ক একবার হলে বাঁচার আর কোনো উপায় থাকে না। তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কিছু উপশম প্রশমনের চিকিৎসা ছাড়া জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর কোনো চিকিৎসা নেই। তবে জলাতঙ্কের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা রয়েছে, যা রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে শরীরে প্রয়োগ করতে পারলে মৃতু্য এড়ানো যায়। জলাতঙ্কের জন্য দুই ধরনের টিকা রয়েছে। ক্ষতের তীব্রতা ও আধিক্যের ওপর ভিত্তি করে কারও ক্ষেত্রে এক ধরনের, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে উভয় ধরনের টিকা প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। যত তাড়াতাড়ি জলাতঙ্কের এ টিকা গ্রহণ করা যায়, ততই মঙ্গল। সাধারণত প্রথম দিন টিকা দেওয়ার পর ৩, ৭, ১৪, ২৮ ও ৯০তম দিনে টিকার মোট ৬টি ডোজ চামড়ার নিচে এ টিকা প্রয়োগ করতে হয়। টিকার সব ক'টি ডোজ সময়মতো গ্রহণ করে টিকার কোর্স সম্পন্ন করা আবশ্যক। যারা কুকুর, বিড়াল বা অন্য প্রাণী লালন-পালন করেন, তারা প্রতিষেধক হিসেবে টিকা দিতে পারেন। প্রথম ডোজ দেওয়ার পর সাত দিনে দ্বিতীয় ডোজ, ২১ বা ২৮ দিনে তৃতীয় ডোজ এবং বুস্টার ডোজ দিতে হবে এক বছর পর। সুতরাং পরিবারের ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে সবার জীবন রক্ষার্থে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া আবশ্যক। বিশেষ করে যারা কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, ইঁদুরসহ অন্যান্য প্রাণী লালন-পালন করেন। আর আক্রান্ত হলে বিলম্ব না করে অবশ্যই নিয়মানুযায়ী টিকাগুলো নিতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। জলাতঙ্ক প্রতিরোধে পোষা ও অ-পোষা সব বিড়াল-কুকুরকে জলাতঙ্কের টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনাও একটি কার্যকর উপায়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই মৃতু্যদূত ব্যাধিকে করায়ত্ত করা সম্ভব। জনস্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, 'দেশকে জলাতঙ্ক মুক্ত করতে জলাতঙ্ক রোগের প্রধান বাহক কুকুরকে ব্যাপক হারে টিকা প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা জরুরি। সুতরাং কুকুরে জলাতঙ্ক রোগ-প্রতিরোধ করে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকেও নিরাপদ করা সম্ভব। বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত যে কোনো দেশ বা এলাকায় শতকরা ৭০ ভাগ কুকুরকে ব্যাপক হারে জলাতঙ্ক টিকা প্রদান করা হলে তাদের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয় তথা সংশ্লিষ্ট এলাকার সব কুকুরই নিরাপদ হয়। ৩ বছরে সঠিকভাবে পর পর তিন রাউন্ড জলাতঙ্ক টিকা প্রদান করা হলে ওই এলাকা বা দেশ জলাতঙ্ক মুক্ত হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। এ ধারণার আলোকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ)-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশে জলাতঙ্ক নির্মূল কার্যক্রমের প্রাথমিক সময় হতেই তথা ২০১২-১৩ সাল হতে ব্যাপক হারে কুকুরে টিকাদান কার্যক্রম (গধংং ফড়ম াধপপরহধ.রড়হ - গউঠ) শুরু করা হয় এবং আজ পর্যন্ত তা চলমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ), বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ), বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা (ঙওঊ) এবং গেস্নাবাল এলায়েন্স ফর রেবিস কন্ট্রোল (এঅজঈ) সম্মিলিতভাবে জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ইতোমধ্যে কার্যকর কিছু কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছে। জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে কুকুরবাহিত জলাতঙ্ক রোগমুক্ত করা। উক্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের প্রস্তুতকৃত জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মকৌশল দেশের অনেকাংশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে যা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আখলাক ই রাসুল

শিক্ষার্থী

ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমাল সায়েন্সেস

গণ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে