সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ধূমপানকে না বলুন

নতুনধারা
  ০৪ জুন ২০২৩, ০০:০০

প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্বজুড়ে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। ২৪ ঘণ্টা তামাক সেবনের সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে দিবসটি প্রচলন করা হয়েছে। এ ছাড়া দিবসটির উদ্দেশ্য তামাক ব্যবহারের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করানো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে। বিগত সময়ে দিবসটি সরকার, জনস্বাস্থ্য সংগঠন, ধূমপায়ী, উৎপাদনকারী এবং তামাকশিল্পের কাছ থেকে উদ্যম এবং প্রতিরোধ উভয়ের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে।

সবাই জানি ধূমপান করলে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু তারপরও জেনে-শুনে মানুষ যেখানে-সেখানে ধূমপান করে। একটি গবেষণায় জানা গেছে, শিশু-কিশোররাও এখন প্রতি দশ জনে একজন ধূমপায়ী। শুধু ধূমপানই নয়, এরা নানা রকমের নেশাও করে এবং ধূমপানের মাধ্যমেই যে কোনো নেশা শুরু হয়। এতে যেমন তাদের দেহের ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই পরিবেশের অন্য মানুষের দেহেরও ক্ষতি হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বিশ্বজুড়ে ধূমপায়ীর সংখ্যা ছিল ১৩২ কোটি। তার দু'বছর পর, ২০২০ সালে এই সংখ্যা নেমে আসে ১৩০ কোটিতে। যে হারে এই সংখ্যা কমছে, তাতে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ধূমপায়ীদের সংখ্যা ১২৭ কোটিতে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে উদ্বেগের কারণ হচ্ছে ধূমপানের কারণে প্রতিবছর বিশ্বে মারা যায় ৮ কোটিরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে ৬ কোটি ৮০ লাখ মারা যান সরাসরি ধূমপানের কারণে। বাকি ১ কোটি ২০ লাখ ধূমপায়ী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে থাকার কারণে মারা যান। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে সাত বছরের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মাশুষ ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। গোটা বিশ্বে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তার নিরিখে ধূমপায়ীদের সংখ্যা এতটা পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় যথেষ্ট আশাবাদী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতি বছর ধূমপায়ীদের সংখ্যা কমছে- এটি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক একটি ব্যাপার এবং এতে আরও বলা হয়েছে, ২০০০ সালে ১৫-১৬ বা ১৮-১৯ বছর বয়সি যেসব কিশোর-কিশোরী ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, ২০২৫ সালে তাদের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই এই বদঅভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসবে।

তামাক বা তামাকজাত পণ্যের ক্ষতি বা স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি সবার কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। সারা পৃথিবী তামাকের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার কমাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অনেক দেশেই তামাকের উৎপাদন ও ব্যবহার উলেস্নখযোগ্য হারে কমে এসেছে, কিন্তু অবাক করার বিষয় বাংলাদেশে ঘটছে তার বিপরীত। তামাক ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী নীতি ও পরিকল্পনার কারণে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এর ফলে ক্যানসারসহ তামাকজনিত বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি জমির উর্বরতা, ফসলী জমি হ্রাস, ফসল উৎপাদন ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। তামাক ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী নীতি ও পরিকল্পনার কারণে আগে অন্যান্য ফসল করা হতো, এমন জমিও ক্রমে বেশি করে তামাক চাষের আওতায় চলে যাচ্ছে। কক্সবাজার ও বান্দরবানের কোনো কোনো এলাকায় ৮০ শতাংশের বেশি জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। শুধু ব্যক্তিগত জমিতেই নয়, খাসজমি, পাহাড়-টিলা দখল করেও ব্যাপক তামাক চাষ হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।

সিগারেটের প্রতিটি প্যাকেটেও লেখা থাকে 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর', 'ধূমপানের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষতি হয়', 'ধূমপান মৃতু্যঝুঁকি বাড়ায়', 'ধূমপান হৃদরোগের কারণ', 'ধূমপান ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়', এসব সতর্কতা সত্ত্বেও মানুষ ধূমপান ছাড়ছে না। অনেক জায়গায় লেখা থাকে যে 'ধূমপান মুক্ত এলাকা' কিংবা এখানে ধূমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেকে তা খেয়াল করার পরও ইচ্ছাকৃতভাবে যেখানে-সেখানে ধূমপান করে। কেউ এর প্রতিবাদ করলে মনে হয় যেন প্রতিবাদকারীই আসল অপরাধী।

জনসমক্ষে ধূমপান আমাদের দেশে হরহামেশাই দেখা যায়। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই এ আইন মানে না। এতে অধূমপায়ী ও শিশুরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে, প্রকাশ্য ধূমপানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় শিশুরা। এদিকে, প্রকাশ্য ধূমপান নিষিদ্ধ আইনের ফলে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় 'অকালজাত শিশু' জন্মের হার প্রায় ১০ ভাগ কমে গেছে বলে এক গবেষণার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

আইন অনুসারে জনসমক্ষে, বিশেষ করে গণপরিবহণ, বার, রেস্তোরাঁ এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ধূমপানবিরোধী আইন প্রয়োগের ফলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুদের স্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব ফেলেছে সে বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, এ আইনের ফলে ইতোমধ্যে বয়স্কদের ক্রমাগত ধূমপানের প্রবণতা কমে গেছে। আজকাল শিশুরাও ধূমপানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিদ্যালয় থেকে বের হয়েই দোকান থেকে বিড়ি বা সিগারেট কিনে তা টানতে টানতে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। স্কুলের বাইরে কেউ কিছু বলবে না এই ভেবে তারা ধূমপান করে। এর ফলে অধূমপায়ী ছাত্রদের ওপরেও খারাপ প্রভাব পড়ছে।

ধূমপান মানুষের অপমৃতু্য ঘটায়। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমগ্র পৃথিবীতে ধূমপানের কারণে যত বেশি অপমৃতু্যর ঘটনা ঘটে, অন্য কোনো রোগ-ব্যাধির কারণে তত ঘটে না। ধূমপানের কারণে শরীরে তাপ বৃদ্ধি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগ-ব্যাধি দেখা যায়। ধূমপানের কারণে রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং অনেক সময় তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ধূমপানকারীর ফুসফুস, মূত্রথলি, ঠোঁট, মুখ, জিহ্বা ও কণ্ঠনালি, কিডনি ইত্যাদিতে ক্যানসার হয়। ধূমপান স্মরণশক্তি কমিয়ে দেয় এবং মনোবল দুর্বল করে দেয়। ইন্দ্রিয় ক্ষমতা দুর্বল করে। বিশেষ করে ঘ্রাণ নেওয়া এবং স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা লোপ পায়।

ধূমপানের ফলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বারবার সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। ধূমপায়ী সব সময় দুর্বলতা অনুভব করে এবং আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। হার্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত ধমনিগুলো বস্নক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। এমনকি বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধূমপান উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়। ধূমপানের ফলে যৌনশক্তি বিলুপ্ত হতে থাকে। ধূমপানের ফলে হজমশক্তি কমে যায়, ধারণক্ষমতা লোপ পায় এবং শরীর ঢিলে হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে পাকস্থলী ক্ষত হতে থাকে এবং যকৃৎ শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধূমপানের ফলে মূত্রথলি যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয় এবং প্রস্রাব বিষাক্ত হয়।

ধূমপান নির্মল পরিবেশকে দূষিত করে। এর ফলে স্ত্রী-পরিজন, সহযাত্রী, বন্ধু-বান্ধব ও আশপাশের লোকজনের কষ্ট হয়ে থাকে। বাসে, ট্রেনে ও অন্যান্য যানবাহনে প্রকাশ্যে ধূমপান করার ফলে অনেক সহযাত্রী নীরবে কষ্ট সহ্য করে মনে মনে ধূমপায়ীকে অভিশাপ দেন। আবার কেউ প্রতিবাদ করে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। অনেকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপমানিত হন। জেনে রাখা উচিত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ধূমপানকারীর প্রতিবেশী শারীরিকভাবে ধূমপায়ীর মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'তামাকজনিত ব্যাধি ও অকালমৃতু্যর কারণে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে বাংলাদেশ' শীর্ষক এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৩০ বছর বা এর বেশি বয়সিদের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ১৫ লাখ মানুষের রোগাক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়সি ৪ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত রোগে ভুগছে। এদের ৬১ হাজারেরও বেশি (১৪ শতাংশ) শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৭১৮ জন। যা জাতীয় পর্যায়ে সব মৃতু্যর প্রায় ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বছরে ব্যয় বাড়ে ৪ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যক্তিগত ও সরকারি ব্যয়, অক্ষমতা/অসুস্থতার কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি এবং অকালমৃতু্যর কারণে উৎপাদনশীলতার ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েল বিং-এর মতে, 'তামাক নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান আইনটি সর্বশেষ সংশোধন হয়েছে ২০১৫ সালে। এতদিনে বদলে গেছে দৃশ্যপট। অনেকেই আবার পাবলিক পেস্নসে ধূমপান শুরু করেছে। এটা কমাতে করের হারও বাড়ানো প্রয়োজন। তাই আইন সংশোধন জরুরি। সংসদের প্রায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য ইতোমধ্যে তামাকের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করেছে। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।'

তবে আজকাল ধূমপান রোধের জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। যেমন- টিভিতে প্রচার, নানা স্থানে ধূমপান রোধের পোস্টার লাগানো, ধূমপান রোধের জন্য নানা সংগঠন তৈরি ইত্যাদি। ধূমপায়ীদের অনেকের পরিবারে একথা জানে আবার অনেকের পরিবারে তা জানে না। যাদের পরিবারে একথা জানে না তারা একথা জানারও চেষ্টাও করে না যে তাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে কি করছে। এর ফলে তারা আরও ছাড় পাচ্ছে। ধূমপানে বিষপান, এটা জীবন ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপায়ীর মতো তার পাশে থাকা অধূমপায়ীও সমান ক্ষতি ও ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ বিষয়টি অনুধাবন করে ধূমপান রোধের জন্য সবার আগে আমাদের নিজেদের সচেতন ও অভ্যাস বদলাতে হবে। আসুন আমরা সবাই ধূমপান ছাড়ি, ঝুঁকিমুক্ত জীবন গড়ি, ধূমপানকে না বলি।

মো. জিলস্নুর রহমান

ব্যাংকার ও কলাম লেখক,

সতিশ সরকার রোড,

গেন্ডারিয়া, ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে