বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবসের তাৎপর্য

  ১১ জুন ২০২৩, ০০:০০
শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবসের তাৎপর্য

আজ ১১ জুন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস। এই দিবসটির স্বতন্ত্র তাৎপর্য অন্বেষণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে। ১১ জুন আমাদের দেশের ইতিহাসে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে সেনাসমর্থিত মেয়াদোত্তীর্ণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘ প্রায় ১১ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ১১ জুন কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি। কারাগারে বন্দি করা হলেও শেখ হাসিনার ২০০৭ সালের ৭ মে আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তন ছিল আমাদের জন্য মঙ্গলকর। ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারির পর তার দেশে ফেরার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু ১৬ জুলাই যৌথবাহিনী তাকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে ৩৩১ দিন কারাগারে বন্দি করে রাখে। সে সময় গণমানুষ তার অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে। তার সাব-জেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের উদ্বেগ, গ্রেপ্তারের সংবাদ শুনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চারজনের মৃতু্যবরণ, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের উৎকণ্ঠা আপামর জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করেছিল। কারণ সে সময় আদালতের চৌকাঠে শেখ হাসিনা ছিলেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা; দেশ ও মানুষের জন্য উৎকণ্ঠিত; বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সত্যকথা উচ্চারণে বড় বেশি সপ্রতিভ। অন্যদিকে সে সময় দলের সভাপতিকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই আওয়ামী লীগের জিলস্নুর রহমানসহ অন্য নেতারা বিভিন্নভাবে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। শেখ হাসিনাকে মুক্তি দেওয়া না হলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে যাবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই সময় কারাগারের অভ্যন্তরে নেত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাকে মুক্তি দেওয়ারও দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। আওয়ামী লীগের ক্রমাগত চাপ, আপসহীন মনোভাব ও অনড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ফলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করা হয়। অবসান ঘটে দুঃশাসনের। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্ষণ ও লুটপাটের মাধ্যমে এ দেশকে নরকে পরিণত করেছিল। নেত্রীকে গ্রেনেড, বুলেট, বোমায় শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক; এখনো তেমনটাই আছেন। এ জন্য করোনা সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে মার্কিন ম্যাগাজিন 'ফোর্বস'। অন্যদিকে ব্রিটেনের 'দ্য ইকোনমিস্ট' মহামারির মধ্যেও এ দেশের অর্থনীতির নিরাপত্তা বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন ছাপিয়েছে।

১৯৭৫ সালে ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর ট্র্যাজেডির ধকল সামলানোর পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নানা রাজনৈতিক কূটচাল, ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। ১৯৭৫ সালে নিজের পরিবারের সবাইকে হারিয়ে যে ভয়াবহ অবর্ণনীয় ব্যক্তিগত বেদনা বহন করতে হচ্ছে তা অকল্পনীয়। সে সময় তিনি ও শেখ রেহানা জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে গেলেও ১৯৮১ সালের পর থেকে তার প্রাণনাশের চেষ্টাগুলো ছিল আরও ভয়াবহ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনাকে ১৯ বারের বেশি প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০৫ সালে মুফতি হান্নান এবং ২০০৬ সালে তার 'গুরু' জঙ্গিনেতা মাওলানা আবু সাইদ ওরফে আবু জাফরকে গ্রেপ্তারের পর জবানবন্দি থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করায় আমরা পরিকল্পনাগুলো জানতে পারি। উপরন্তু আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটেও এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যাচেষ্টার অনেক মামলার বিচার আজও শেষ হয়নি। তবে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানের গণহত্যার মামলা, গ্রিন রোডে হামলার মামলা এবং সুরাহা হয়েছে ঈশ্বরদীর ঘটনা, সাজা পেয়েছে গোপালগঞ্জে বোমা হামলার পরিকল্পনাকারীরা। ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো ছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যায়ে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে আরও অন্তত পাঁচ দফা। শেখ হাসিনার ওপর এ সব হামলার ঘটনায় অন্তত ৬৬ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হওয়ার হিসাব আছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এ সব ঘটনায় যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো এখনো বিচার পায়নি। এইচএম এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালে দুটি, ১৯৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চারটি, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে চারটি, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে চারটি, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একটি ও আওয়ামী লীগের গত আমলে চারটি হত্যাচেষ্টার কথা জানা যায়। সরাসরি শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করেই হামলা চালানোর ১৪টি ঘটনায় মামলা হলেও এ পর্যন্ত সব মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়নি। বেশকিছু মামলা এখনো বিচারাধীন রয়েছে।

শুধু ঢাকাতেই শেখ হাসিনার ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয় ৭ বার। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয়ের সামনে তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। তখন মারা যান যুবলীগ কর্মী। ৮৯ সালের ১১ আগস্ট ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা করে ফ্রিডম পার্টি। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচন চলাকালে রাজধানীর গ্রিন রোডে ও ৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডির রাসেল স্কোয়ারে জনসমাবেশে গুলিবর্ষণ করা হয়। এরপর ৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় যাওয়ার পথে কারওয়ান বাজারে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। আর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালানো হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে। সেখানে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও মারা যান আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী। আলোচিত এ মামলাটির বিচারকার্য সম্পন্ন শেষে রায় হয়েছে ১৪ বছর পর। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, ঈশ্বরদীতে ৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় হামলা হয় ২০০০ সালের ২০ জুলাই। কোটালীপাড়ার মামলাটির ইতোমধ্যেই বিচারকার্য সম্পন্ন হয়ে রায়ও কার্যকর হয়েছে। খুলনায় ২০০১ সালের ২৯ মে, একই বছর ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে, ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয়, ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ও ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র হামলা করে হুজি, জেএমবি, জামায়াত ও বিএনপি। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনায় যারা জড়িত ছিল পাকিস্তান ভাবধারার রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ওই একই আসামিদের, একই ষড়যন্ত্রকারীর পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।

দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত হয়েও তিনি সেনা সমর্থিত শাসকদের মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলার কারণে পিতা বঙ্গবন্ধুর মতো কারাগারে যান। জেলে থাকার কারণে তিনি তার সন্তান পুতুল ও জয়ের পাশে সব সময় থাকতে পারেননি। এই বেদনা তিনি তুলে ধরেছেন নিজের লেখায়। রাজনীতির শেকলে একজন মা কতটা অসহায়, তার বর্ণনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে।

কারামুক্তি দিবসে বলতে হয় শেখ হাসিনা সাহসী, প্রাজ্ঞ, কর্মঠ একজন রাষ্ট্রনায়ক। তার সৎ নেতৃত্বের কারণেই আমরা সুশাসন নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

অতীতের জেল-জুলুম, হত্যার প্রচেষ্টা এবং হুমকি আর বর্তমানের অপপ্রচারের মধ্যেও তার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংকট নিরসন করে সবরকম বিপর্যয় থেকে উঠে দাঁড়াতে হবে,- তার কারামুক্তি দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ড. মিল্টন বিশ্বাস

অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে