সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

তৃতীয় লিঙ্গের সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার

তৃতীয় লিঙ্গরাও মানুষ, দেশমাতার সন্তান- এটা অস্বীকার করা যাবে না। তৃতীয় লিঙ্গদের পুনর্বাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করা হলে তৃতীয় লিঙ্গদের অন্য পথ অবলম্বন করে বেঁচে থাকার দরকার হবে না। পুলিশের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। রাষ্ট্র যদি তৃতীয় লিঙ্গদের মানুষ হিসেবে গণ্য করে মানুষের মতো বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তৃতীয় লিঙ্গের বিড়ম্বনার চির অবসান হবে আশা করা যায়।
জহির চৌধুরী
  ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

একটি জাতীয় দৈনিকে 'তৃতীয় লিঙ্গের বিড়ম্বনা ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে সম্প্রতি। তা থেকে জানা গেছে, রাজধানীতে তৃতীয় লিঙ্গের বিড়ম্বনা ঠেকাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে রাস্তার মোড়, বিপণিবিতান ও আবাসিক এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের টাকা আদায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কেউ নতুন করে নামতে চাইলে পুলিশ তাদের বুঝিয়ে নিবৃত্ত করছে। এই প্রক্রিয়া ধরে রাখতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। নিয়েছে নানা পরিকল্পনা। তৃতীয় লিঙ্গদের পুনর্বাসন অথবা তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। তৃতীয় লিঙ্গের বিড়ম্বনায় শুধু রাজধানীর নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষও অতিষ্ঠ- এটা বাস্তবতা। রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহরসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তৃতীয় লিঙ্গের জোরজবরদস্তি টাকা আদায়, টাকা আদায়ের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষকে নাজেহাল-অপদস্থ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, গালি-গালাজসহ নানা কায়দায় হেনেস্থের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।

তৃতীয় লিঙ্গের বিড়ম্বনা বহুদিনের সমস্যা। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান দরকার। এজন্য সমস্যার কারণ খতিয়ে দেখে করণীয় নির্ধারণ প্রয়োজন। তৃতীয় লিঙ্গরা জোর-জবরদস্তি টাকা আদায় করে, পথে-ঘাটে, বাসাবাড়িতে বিরক্ত করে, চাঁদাবাজি, অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়- এটা সর্বজনবিদিত। তৃতীয় লিঙ্গরা কেন এসবে লিপ্ত হয় তাও বলা যায় জানা। তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের মনোভাব-দৃষ্টিভঙ্গিই তৃতীয় লিঙ্গের কুপথ অবলম্বনের জন্য মূলত দায়ী বলা যায়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি তৃতীয় লিঙ্গদের জীবন দুর্বিষহ করে রেখেছে, বেঁচে থাকা কঠিন করেছে- এটা অস্বীকার করা যাবে না। সবাই জানেন যে, পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে তৃতীয় লিঙ্গরা বোঝা, জঞ্জাল, পরিত্যাজ্য বস্তুর মতো। জন্মের পর তৃতীয় লিঙ্গকে পরিবার থেকে আবর্জনার মতো ফেলে দেওয়া হয়, আর্বজনার মতো ফেলে দেওয়া তৃতীয় লিঙ্গের ঠাঁই হয় সমাজঘৃণ্য তৃতীয় লিঙ্গের সমাজে। পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে তৃতীয় লিঙ্গের সমাজে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। প্রয়োজন আইন মানে না। বেঁচে থাকার তাগিদেই তৃতীয় লিঙ্গদের চাঁদাবাজি, অপরাধমূলক ও অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকে না। বলা অন্যায্য হবে না যে, তৃতীয় লিঙ্গদের প্রতি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যায়, অন্যায্য, মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন।

তৃতীয় লিঙ্গরাও মানুষ গোত্রভুক্ত। পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের মানুষের মতো তৃতীয় লিঙ্গরাও মানুষের ঘরে জন্ম নেওয়া মানবসন্তান। মানবসন্তান হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গরাও পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের মানুষের সমমর্যদা-অধিকার পাওয়ার দাবিদার। তৃতীয় লিঙ্গদের মানুষ গণ্য না করার, পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের মানুষের সমমর্যদা-অধিকার না দেওয়ার গ্রহণযোগ্য যুক্তি নেই। কেউই নিজের ইচ্ছায় বা দোষে তৃতীয় লিঙ্গ হয়ে দুনিয়ায় আসে না। ইংরেজিতে হিজড়ার প্রতিশব্দ (ঊঁহঁপয) ইউনাক, যার অর্থ নপুংসক বা খোজা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, ক্রোমোজেমের ত্রম্নটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মের পর লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয় তারাই হিজড়া। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এ অভিমত অনুযায়ী, তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধীর অর্ন্তভুক্ত ধরা যায়। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের (দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ইত্যাদি) প্রতি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সহানুভূতি দেখায়, নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়। তৃতীয় লিঙ্গরা যৌনপ্রতিবন্ধী হওয়ায় শারীরিক প্রতিবন্ধীর পর্যায়ে পড়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধীর অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি ঘৃণা পোষণ, বৈষম্য দেখানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

তৃতীয় লিঙ্গরাও পুরুষ এবং স্ত্রী লিঙ্গের মানুষের মতো দেশ-জাতি গঠনে অবদান রাখতে পারে। এর ভুরিভুরি প্রমাণ আছে। দিলিস্নর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দুর্ধর্ষ সেনাপতি মালিক কাফুর ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল দরবারে উচ্চ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে তৃতীয় লিঙ্গ/খোজা নিয়োগের নজির রয়েছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি দপ্তর/প্রতিষ্ঠানে সীমিতসংখ্যক হলেও তৃতীয় লিঙ্গ কাজ করার নজিরও আছে। এক সময় আমাকে ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অধীনস্থ এল এ বিভাগে বহুবার যেতে হয়েছে। সে সময় সেখানে আক্রাম নামে তৃতীয় লিঙ্গের একজনকে পিয়ন পদে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। সম্প্রতি তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। তৃতীয় লিঙ্গের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা/ অযোগ্যতার অভিযোগ শোনা যায়নি। তৃতীয় লিঙ্গরা কাজে-কর্মে, মেধা, যোগ্যতায় পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের চেয়ে যে কোনো অংশে কম নয় তা প্রমাণিত। পূরাণে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে উলেস্নখ করা হয়েছে 'তৃতীয় প্রকৃতি' হিসেবে। তৃতীয় লিঙ্গদের প্রকৃতির খেয়াল বলা যায়। তৃতীয় লিঙ্গদের মানুষের মর্যাদা-অধিকার দিতে হবে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার প্রয়োজনেই। তৃতীয় লিঙ্গরাও মানুষ, দেশমাতার সন্তান- এটা অস্বীকার করা যাবে না। তৃতীয় লিঙ্গদের পুনর্বাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করা হলে তৃতীয় লিঙ্গদের অন্য পথ অবলম্বন করে বেঁচে থাকার দরকার হবে না। পুলিশের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। রাষ্ট্র যদি তৃতীয় লিঙ্গদের মানুষ হিসেবে গণ্য করে মানুষের মতো বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে তৃতীয় লিঙ্গের বিড়ম্বনার চির অবসান হবে আশা করা যায়।

জহির চৌধুরী : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে