সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতিতে আস্থার সংকট

সংলাপে সংকটের সমাধান হোক। দেশের মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ভয়ভীতি বিরাজ করছে তা দূরীভূত হোক। তা না হলে দেশ ভয়াবহ সংকট ও রাজনৈতিক সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এতে শুধু দেশের জান-মাল সম্পদই নয় গণতন্ত্র হবে বিপন্ন।
মোহাম্মদ নজাবত আলী
  ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ৫২ বছর হলেও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা বা সংসদীয় গণতন্ত্রের ৩২ বছরেও গণতন্ত্র তেমন বিকাশ লাভ করেনি। তেমনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিক সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা এখনো তৈরি করতে পারেনি এদেশের রাজনীতিবিদরা। শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাই নয়, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তার দিকনির্দেশনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে চরম বিতর্ক চলছে। যা জাতির জন্য চরম ব্যর্থতা ও হতাশা।

'৯০-এর গণ-অভু্যথনের পর যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তাতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তার সভাসদ বর্গের সামনে দরবার হলে বলেছিলেন, বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা। এ কথাটি বলেছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সার্ভভৌমত্ব রক্ষা, অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমরা তো স্বাধীন দেশের নাগরিক। কিন্তু কেন আজ দেশের রাজনীতি, আকাশে দুর্যোগ ও অশনিশংকেত? এর মূল কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি। তবে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশ বিশেষ করে বড় দু'দলের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার সংকট। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করেন। সেই থেকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে আসছেন। এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত।

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঢাকায় বড় দুটি সমাবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ করেছে অপরদিকে বিএনপি সরকার পতনে এক দফার নামে সমাবেশ করেছে। এ যেন পাল্টাপাল্টি সমাবেশ। বিএনপি ইতোমধ্যে রাষ্ট্র মেরামতের নামে ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। বড় দুটি দল যখন সমাবেশ করে তখন ঢাকায় অবস্থান করছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তিনি বড় দুটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। বৈঠকে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষট্র ভূমিকা রাখতে চাইলে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার ব্য ক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা শুধু বিদেশি রাষ্ঠ্রই নয় সাধারণ জনগণ সেটাই কামনা করে। আগামী নির্বাচন নিয়ে, অশুভ রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে তা নিরসনে সুষ্ঠু সমাধান হচ্ছে না। উভয় দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। এরপার উজরা জেয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। এ বৈঠকেও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ বলছে শেখ হাসিনার অধীন অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। অপরদিকে বিএনপি বলছে, শেখ হাসিনার অধীন তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। সরকারও সংবিধানের বাইরে যাবে না। অন্যদিকে বিএনপি'র নেতৃত্বে গঠিত বিরোধী দল আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীন তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এর বাইরে নয়। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে শান্তি ও উন্নয়নের সমাবেশ করে। অপরদিকে বিএনপি সরকারের পদত্যাগে পদযাত্রা করে। এতে বড় দুদলের নেতাকর্মী ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে লক্ষ্ণীপুরে একজন নিহত হয়। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে বলে সাধারণ জনগণের মাঝে উদ্বেগ ও শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধী দলের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তারা ছায়াসরকার হিসেবে ক্ষমতাশীন সরকারকে সাহায্য করবে। জাতীয় ইসু্যতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের বিপরীতে সৌহার্দ ও সম্প্রীতি গড়ে উঠবে, গণতন্ত্রের চর্চা হবে, গণতন্ত্র বিকশিত হবে। কারণ গণতন্ত্রের অর্থ হলো ঐক্য, ধের্য্য, সহনশীলতা ও পরমত সহিষ্ণুতা। দ্বন্দ্ব সংঘাত, হানাহানি গণতন্ত্রের ভাষা নয়। ব্যক্তিগত ও দলীয় আক্রমণ গণতন্ত্রের অর্থ নয়। আর গণতন্ত্রের অর্থ স্বেচ্ছাচারিতাও নয়। ক্ষমতার দাপটে যা ইচ্ছা তা নয়। দমন পীড়ন নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের রাজনীতিবিদরা দেশ জাতির কল্যাণে বড় ধরনের অবদান না রেখে ব্যক্তি স্বার্থে জড়িয়ে পড়ে। আত্মবিশ্লেষণ না করে শুধু অন্যদের দোষ খুঁজে বেড়ায়। গণতন্ত্রের কথা বলবো অথচ গণতান্ত্রিক আচরণ করব না, সংসদের কথা বলব অথচ সংসদকে কার্যকর করব না এগুলি গণতান্ত্রিক পথ নয়। আর এভাবে বার বার আমরা গণতন্ত্রের চর্চা ও জাতির উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে পড়ছি।

বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে এ নিরসনের উপায় কি? হয়তো হবে। কিন্তু হওয়ার আগেই যদি রাজনৈতিক অঙ্গন যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে, বড় দুটি দল তাদের নিজ নিজ অবস্থানে রাজপথ দখলের চেষ্টা করছে তাতে ভবিষ্যতে দেশ যে সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। উভয় দলের সহযোগী, অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার মহড়া দেয় তাহলে সেটা হবে গণতন্ত্রের জন্য অশুভ আচরণ। কেননা এখনো আমরা প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যেখানে ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। সেখানে স্বাধীনতার ৫২ বছরে আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে দেশের উন্নয়নে এক কাতারে দাঁড়াতে পারেনি। যদি পারত তাহলে রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আসত। রাজনৈতিক হানাহানি দ্বন্দ্ব সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান হতো। দেশ আরও অনেক এগিয়ে যেত। অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হতো। গণতন্ত্রের ভিত আরও মজবুত হতো। গণতন্ত্রের চর্চা হতো। আমাদের বড় দলের আলাপ-আলোচনা বা সম্মতিক্রমে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলো। তারা বিশ্বাস করল সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় দেশকে চালিত করা উচিত। কিন্তু এখন তারা গণতন্ত্র নিয়ে এক ধরনের খেলা শুরু করেছেন। কোনো সরকারের অধীন নির্বাচন হবে বা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কিরূপ হবে এ নিয়ে আমাদের বড় দু'দল বিপরীত মেরুতে অনড়। ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সংঘাত দেশকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে তা নিয়ে সর্ব মহল শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন।

ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি সংবিধানের বাইরে যাবেন না। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন চান। কিন্তু উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেন। অতীতে দেখা গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৩ মাসের জন্য ক্ষমতায় এসে ২ বছর ক্ষমতায় ছিল। দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছিল। অনেক রাজনীতিবিদকে হেনস্তা করা হয়েছিল। এ বিষয়গুলোও দেশের রাজনীতিবিদদের অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীন নির্বাচন হলেও পরাজিত দল অতি সুক্ষ্ণ কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করবেন যা অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের সেটাই স্মরণ করে দেয়। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট। এ সংকট যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জিইয়ে থাকে তাহলে যে পদ্ধতিতেই নির্বাচন হোক না কেন একটা বিতর্ক তৈরি হবেই। কাজেই গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখতে ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এ সংকটের সমাধান হতে পারে।

একটি রাষ্ট্র সমাজকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনে মানুষ সংবিধান রচনা করেছেন। ৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর সংবিধান কার্যকালের দিন থেকে এ ৫২ বছরে বর্তমান পর্যন্ত অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। আর এ সংশোধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন করা হয়েছে কখনো রাষ্ট্র জনগণ আবার কখনো ক্ষমতাসীনদের সুবিধার জন্য। আর এসব করেছে রাজনীতিবিদরাই। সর্বশেষ দেশের উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। যার কারণেই রাজনৈতিক সংঘাতের সূত্রপাত যা এখনো চলছে। অথচ আমাদের দু'দলই এক সময় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। ৯০ দশকেও আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশে যে রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে যে কোনোভাবেই হোক রাজনীতিবিদদের সমাধান বের করতে হবে গণতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখতে। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে দেশ ও জনগণের স্বার্থে গণতন্ত্রকে সমন্বত রাখতে হবে। সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে সরকারকে এগুতে হবে। আশা-নিরাশার দোলাচলে চলছে রাজনীতি। আমাদের যাত্রা হওয়া উচিত শান্তির দিকে, সংঘাতের দিকে নয়।

কাজেই দেশের সর্বমহল ও শান্তিপ্রিয় মানুষ এখনো আশাবাদী আলাপ-আলোচনা সংলাপের মাধ্যমে বিদ্যমান সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোকেই বের করতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। তাই একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সংলাপে সংকটের সমাধান হোক। দেশের মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ভয়ভীতি বিরাজ করছে তা দূরীভূত হোক। তা না হলে দেশ ভয়াবহ সংকট ও রাজনৈতিক সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এতে শুধু দেশের জান-মাল সম্পদই নয় গণতন্ত্র হবে বিপন্ন।

মোহাম্মদ নজাবত আলী :শিক্ষক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে