সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

শিশুর সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে চিত্রাঙ্কনের গুরুত্ব

রাব্বি ইসলাম
  ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

একটি শিশুর শৈশবের নির্মাতা হচ্ছে অভিভাবক বা শিক্ষক। কাদামাটির মতো এই শিশুদের যেমন ইচ্ছা গড়ে নেওয়া যায়। আমরা যেমন চাইব সেভাবে তারা গড়ে উঠবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে রূপদান করবে। তাই বলে ভূল রূপদান যেন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা আমাদের ভালোবাসা তাদের দিতে পারি কিন্তু চিন্তাভাবনা নয়, কারণ তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে। আসলে কোমল শিশুদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু চাপিয়ে দিলে তাদের স্বপ্নগুলো ভেঙে যায়। নিজে থেকে কিছু করার বা চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলে তার সৃজনীশক্তি। আর অভিভাবকদের চিন্তা ও শিক্ষার মান যদি হয় সংস্কারবদ্ধ তাহলে শিশুর বিকাশের গোড়াতেই তার মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের কখনো জিজ্ঞাসা করে না, তোমার কি হওয়ার স্বপ্ন আছে? তুমি কি হতে চাও?। অভিভাবকরা তাদের নিজেদের স্বপ্নগুলো চাপিয়ে দেয় সন্তানের ওপর। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, করপোরেট অফিসার আরও কত কি! কিন্তু তারা ভুলে যায় পৃথিবীতে সবাই সব কিছুর জন্য আসেনি। সবাই একদিকে গেলে পৃথিবী তার ভারসাম্য হারাবে। অভিভাকদের এটা বুঝতে হবে আপনার সন্তানের নিজস্ব চিন্তাধারা আছে। তার চিন্তাধারাগুলোকে বিকশিত হতে দিন। না হলে আপনার সন্তান আজীবন শিশুই রয়ে যাবে, মানুষ হয়ে আর উঠবে না। আমাদের মনে রাখা উচিত, মানুষের জীবনের ছোট্ট একটা সময় তারা শৈশবে পার করে কিন্তু এই অল্প সময়টুকু একটি মানুষের জীবনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই আমাদের উচিত শিশুদের এমন একটি শৈশব দেওয়া যা নিরবচ্ছিন্ন আনন্দে ভরপুর থাকে এবং সেই সঙ্গে সে জীবনকে গড়ে তোলার রাস্তা খুঁজে পায়। আর তার নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে এবং নিবিড়ভাবে জানতে বা পরখ করতে সব থেকে বেশি সহায়তা করে ছবি আঁকা। মানুষ সেই আদিমকাল থেকে যেসব মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছবি আঁকা। শিশুরাও তাদের চেতনার উদয়কাল থাকে ছবি অঙ্কন করতে পছন্দ করে। ছবি অঙ্কনের মাধ্যমে একটি শিশু নিজেকে আবিষ্কার করে নানাভাবে। তাদের হাতের আঁকা ছবিতে ফুটে ওঠে তাদের না বলা কথা। শিশুরা আপন মনে নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য দেয়ালে, মেঝেতে, মাটিতে, কাগজে ও বালিতে আঙুল, কাঠ, কয়লা, চক, পেন্সিল ইত্যাদি দিয়ে ছবি আঁকা শুরু করে এর মাধ্যমে তার সৃজনীশক্তি, কল্পনাশক্তি, নান্দনিকবোধ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে। একটি শিশুর মানসিক বিকাশে খেলাধুলা, সঙ্গীত, বই পড়া ইত্যাদি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এগুলো খুব সহজ এবং সুন্দর পন্থা। তবে তাদের মতে, চিত্রাঙ্কন বা ছবি আঁকা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে শিশুর মনে। শিশুরা খুব সহজ এবং সাবলীলভাবে তার চারপাশটা বোঝার চেষ্টা করে। তারা সবসময় নিজেদের মনের সব কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু অবস্থায় আঁকাআঁকির অভ্যাস গড়ে উঠলে, মনের ভাষা প্রকাশের অন্যতম একটি মাধ্যম হতে পারে ছবি আঁকা। শিশুর মনে সে কী পালন করে, সে কী ভাবছে, তার আশপাশের পরিবেশটা কেমন এ সবই তার আঁকানোর মধ্যে ফুটে ওঠে। শিল্পী এসএম সুলতান, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছোটবেলা থেকেই এই ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়েছেন। তারা জন্মগতভাবে চিত্রাঙ্কনের কারিগর ছিলেন। পৃথিবীর সব চিত্রকর তাদের চিত্রকর্ম দিয়ে সমাজের কল্যাণ করে গেছেন। তারা দুঃখী মানুষের জন্য ছবি এঁকেছেন। সমাজকে বদলে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের শিশুরাই আগামী দিনের কান্ডারি। তাদের মানসিক বিকাশ হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। চিত্রাঙ্কন হতে পারে তার অন্যতম মাধ্যম। শিশুরা তার আশপাশের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, পরিবেশ তার ছবির ভাষায় তুলে ধরবে। শিশু যখন তার আশপাশের পরিবেশকে শিশুকালে অনুধাবন করতে শিখবে, পরবর্তীতে সে এই অনুধাবনকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারবে। যা শিশুর ব্যক্তিজীবন তথা দেশ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে। শিশুর এই আঁকার মধ্যেই তার মানসিক অবস্থা, চিন্তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন তার মা-বাবা। যা সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি করে তারা অন্যদের তুলনায় চিন্তা ও মননে অনেক এগিয়ে। তাদের চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। তারা সামগ্রিক দিক নিয়ে ভাবতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুর কচি মস্তিষ্কে যত সৃজনশীল কাজ করবে, তার চিন্তা তত বেশি পরিষ্কার হবে। আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড গার্ডেনারের মতে, একজন শিশু তার শৈশবের প্রাথমিক বিকাশকালে সর্বোমোট ১২টি পদ্ধতিতে তার মানুষিক বিকাশ ঘটিয়ে থাকে যার ভিতরে উলেস্নখযোগ্য একটি হচ্ছে- 'ভিজুয়াল লার্নিং মেঠড' এই পদ্ধতিতে, শিশুরা তার আশপাশের পরিবেশ থেকে বিভিন্ন শব্দ ও ছবি শোনা এবং দেখার মাধ্যমে সেই বস্তুটা সম্পর্কে তার মনোজগতে একটি চিত্র তৈরি করে নেয় এবং সেটা সম্পর্কে সে তার নিজস্ব একটি ধারণা তৈরি করে। সে তার ধারণাকে প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে ছবি আঁকাকে বেছে নেয়, আর এভাবেই ছবি আঁকার মাধ্যমে শৈশবের প্রাথমিক বিকাশকালে একজন শিশু তার ভিজুয়াল লার্নিং দক্ষতাকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশবে শিশুরা যদি ছবি আঁকার সুযোগ পায়, তাহলে তারা মেধাবী ও বুদ্ধিমান হয় বিজ্ঞানীদের মতে, শিল্পচর্চার মাধ্যমে শিশুদের সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অভিনব চিন্তার মাধ্যমে শিশু যখন বিভিন্নভাবে শিল্পচর্চার সুযোগ পায়, তখন তার সৃজনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। সে অসাধারণভাবে ভাবতে ও চিন্তা করতে শেখে, যা তাকে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে শেখায় এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে সে তখন সহজেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এরপরেও অনেকে প্রশ্ন করতে পারে অঙ্কনের উপকারিতা কি? শিশুরা ছবি আঁকলে কী উপকার হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রভাষক কামালুদ্দিন বলেন- একজন শিশু ছবি আঁকলে- ১, পরিমিতিবোধ বাড়ে। ২, রুচিবোধ বা নান্দনিকতাবোধ বাড়ে। ৩, সৌন্দর্যবোধ বাড়ে। ৪, চোখ ও মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র কার্যকর ও শক্তিশালী হয়। ৫, চিন্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে সেই সঙ্গে আত্মশক্তি প্রতিষ্ঠা হয়। ৬, নিয়মশৃঙ্খলাবোধ শেখে। ৭, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। ৮, কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। ৯, মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। ১০, জীবন উপলব্ধি বাড়ে। ১১, দেশপ্রেম জাগ্রত হয়?১২, সময়ানুবর্তিতা বাড়ে। ১৩, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয়। ১৪, চেতনাবোধ জাগ্রত হয়। ১৫, একাকিত্ব অনুভব করে না এবং ১৬, প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। সুতরাং আমরা চাইব আমাদের শিশুরা যেন উক্ত মর্মবাণীগুলো ধারণ করতে পারে। শিল্পী এস এম সুলতান বলেছিলেন- 'যে শিশু একবার তুলি ধারণ করে, সে শিশু কখনো অস্ত্র ধরতে পারে না।' সত্যিকার অর্থে শিল্প সংস্কৃতি না থাকলে মানুষের আশার মৃতু্য ঘটে। তাই শিশুরা যেন সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিল্পশিক্ষা বিশেষ করে ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করতে পারে এবং নিজেকে উন্নত মননশীল, রুচিশীল আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সে জন্য আমাদের দরকার শিশু প্রতিপালনে সচেষ্ট হয়ে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে ত্বরান্বিত করা।

রাব্বি ইসলাম

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে