রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন শিক্ষাক্রম যথার্থ বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি জরুরি

জুনায়েদ মাসুদ, শিক্ষার্থী শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
  ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত বাজেটই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মূল চালিকাশক্তি। উন্নত দেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হলে বাজেটে শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিকল্প নেই। স্বর্গীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেও তা ফলপ্রসূ হবে না, যদি না শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ না রাখা হয়।

কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো; আমাদের শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না। ইউনেস্কোর পরামর্শ অনুযায়ী, একটি দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। অথচ, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি (মোট দেশজ উপাদান) অনুপাতে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় কম। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

শিক্ষাব্যবস্থার দেখভালকারী দুটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন কার্যক্রমের জন্য ২৩-২৪ জাতীয় বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১২ শতাংশের মতো। অবশ্য, শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ যোগ করলে এই হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে অতীতের মতো এবারও দাবিটি পূরণ হয়নি, বরং বরাদ্দের হার কমে ২০ শতাংশ থেকে বেশ দূরেই আছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাবর্ধক, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে বর্তমানে বিভিন্নমুখী নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে।

এমতাবস্থায় আমাদের সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি মোকাবিলা করতে হবে, তা হলো এই শিক্ষাক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন।

এই অপর্যাপ্ত বাজেটের স্পষ্ট প্রতিফলন প্রকাশ পুরো শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর শিক্ষার্থীদের নতুন পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে, এতে খুবই নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। যা শিক্ষায় অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কারণ বলে মনে করেন অনেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। ভালো শিক্ষাক্রম নিশ্চিতকরণের পূর্বে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত বই দিতে হবে।

বাজেটের অপর্যাপ্ততার কারণে স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে, এমন পাঠদান উপকরণ যার ব্যবহারে শিক্ষক পাঠদানকে প্রাণবন্ত করতে পারেন। যার ফলে শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। পাঠ্যবই থেকে তথ্য মুখস্থ করলেও সেটা ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটিয়ে বোঝার মতো যথেষ্ট উপকরণ নেই শ্রেণিকক্ষে।

এ ছাড়া দেশের সিংহভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই গ্রন্থাগার ব্যবস্থা, নেই কোনো গবেষণাগার। এতে করে শিক্ষার্থী পাঠ্যবইয়ের বাইরে গিয়ে জ্ঞান আহরণ কিংবা এর অনুশীলন করার উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রণীত বইয়ের পাঠ শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণরূপে আয়ত্ত করাতে হলে তাদের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য গবেষণাধর্মী বই পড়তে উৎসাহিত করা হবে। পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের জন্য গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার প্রয়োজন।

যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রমে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাই শিক্ষকদের সময়োপযোগী পাঠদান দক্ষতার ঘাটতিও অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকেবিলা করতে শিক্ষকদের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।

কারণ, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের পুরনো পাঠদান পদ্ধতি প্রয়োগযোগ্য নয় এবং তা সময়োপযোগীও নয়। প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। দক্ষ শিক্ষক তৈরি করতে লাগবে দক্ষ প্রশিক্ষণ। যাতে করে শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাক্রমকে সময়োপযোগী পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে পারেন। এ ছাড়াও নতুন কারিকুলামের ফলে শিক্ষা এখন শুধু বইভিত্তিক নয়; বরং অনেকাংশেই ব্যবহারিক ও দক্ষতানির্ভর। আর এসবের ব্যবস্থা করতে বিশাল অংকের অর্থের প্রয়োজন হবে। কিন্তু, আমাদের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ পর্যাপ্ত নয়।

এ ছাড়া, উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন অনেক কম। শিক্ষাক্রমের যথার্থ বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষকদের বেতন অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বেশি, তাই সে দেশের উচ্চশিক্ষিতরা পিএইচডি করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। উদাহরণ হিসেবে ফিনল্যান্ডকেই ধরা যায়। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন প্রদানে ফিনল্যান্ড বিশ্বের সেরা। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষকদের নামমাত্র বেতন দেয়া হয়। ফলে শিক্ষকরা নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদার সঙ্গে আয় মেলাতে না পেরে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে বাড়তি টাকা আয় করার চিন্তা করেন। এতে করে শ্রেণি পাঠদানের মান কমে যায়। ফলস্বরূপ কোচিং বাণিজ্যের আধিপত্য বাড়ে। সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যেমনটি শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য কোচিং বাণিজ্যের আধিপত্য থামানো। শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমানো। এমনটা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দিলে তবেই ক্লাসে শিক্ষন মান বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষক শিক্ষাদানে অনুপ্রেরণা পাবেন। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষাটা পাবে। তারা কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকবে না।

এর পাশাপাশি শিক্ষা প্রকল্পের অর্থ অপচয় রোধ এবং যথাযথ বাস্তবায়ন করা জরুরি। এযাবত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বহু প্রকল্প নেওয়া হলেও এর শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। হয়েছে অর্থের অপচয়। আবার কোথাও কোথাও দেখা গেছে, অপরিকল্পিত কাজের দৃশ্য। এর পেছনে অদক্ষ পরিকল্পনা, পাশাপাশি জবাবদিহিতার অভাবকে দায়ী করা যায়।

পরিশেষে বলা বাহুল্য, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি শিক্ষার্থীর ভিত্তি তৈরি হয়। এখান থেকেই শিক্ষার্থীর জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ ঘটে। যেটা তাকে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনার দিকে প্রসারিত করে। এই শিক্ষার মানের ওপরই ভিত্তি করে সে দেশের জন্য আদৌও কতটুকু মানবসম্পদে পরিণত হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম আজকের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে সক্ষম। তবে, এই সক্ষমতা অর্জন করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় বরাদ্দ বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা ফিনল্যান্ডের শিক্ষাক্রম নিয়েছি। এই শিক্ষাক্রমের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হলে তাদের মতো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে