শিক্ষা একটি জাতির উন্নতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি। এটি শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়নের নয়, বরং সামাজিক অগ্রগতিরও নিয়ামক। কিন্তু শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রসঙ্গ এলে আমরা প্রায়ই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষা করি। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অগ্রাহ্য করে শিক্ষার প্রকৃত মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থীই কেবল সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং গভীর চিন্তাভাবনায় দক্ষ হতে পারে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেতে হলে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি আমাদের নীতিমালার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেতে হবে।
বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের জীবনে মানসিক স্বাস্থ্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কঠিন প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা, পরীক্ষার চাপ, সামাজিক প্রত্যাশা এবং পারিবারিক দায়বদ্ধতা শিক্ষার্থীদের ওপর এমন একটি বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে- যা তারা অনেক সময়ই সামলাতে পারে না। আধুনিক প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করার প্রবণতা, তথ্যের অতিরিক্ত প্রবাহ এবং অল্প বয়স থেকেই 'সেরা' হওয়ার প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার মান উন্নয়নের প্রসঙ্গ তোলার আগে আমাদের বিবেচনা করতে হবে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য। একটি শিক্ষাব্যবস্থা তখনই কার্যকর হতে পারে, যখন সেটি শিক্ষার্থীদের শিখন-প্রক্রিয়াকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থীরা একাগ্রতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়, তাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রতি নিষ্ঠ থাকে এবং জীবনকে ইতিবাচকভাবে উপভোগ করতে পারে। অন্যদিকে, মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি করে এবং তাদের শিখন-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে।
শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং কাউন্সেলিং সেবা চালু করা জরুরি। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারে, এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেন শিক্ষার্থীদের মানসিক চাহিদা বুঝতে পারেন এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা করতে পারেন, সেই দক্ষতা অর্জন করা উচিত। শিক্ষার্থীদের আচরণ, মনোযোগের ঘাটতি বা হতাশার মতো বিষয়গুলো বুঝতে পারলে শিক্ষকরা দ্রম্নত পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
তৃতীয়ত, আমাদের পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। পরীক্ষার অতিরিক্ত চাপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে- যা তাদের শিখন-প্রক্রিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। মূল্যায়নের বিকল্প পদ্ধতি, যেমন প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন, চালু করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন প্রক্রিয়া নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে।
পারিবারিক পরিবেশও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করে। পরিবারের সদস্যদের উচিত শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত রাখা এবং একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিশেষভাবে উলেস্নখ করা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া কোনো ক্ষেত্রেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার মান উন্নয়নেও এটি ব্যতিক্রম নয়। মানসিকভাবে সুস্থ শিক্ষার্থীরাই ভবিষ্যতে একটি সৃজনশীল, উদ্ভাবনী এবং সহনশীল সমাজ গড়ে তুলতে পারে।
তাই শিক্ষার মান উন্নয়নের যে কোনো পরিকল্পনায় মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা মানে তাদের শিখন-প্রক্রিয়াকে অর্থবহ করে তোলা। এটি শুধু তাদের একাডেমিক সাফল্য নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণের সময় এখনই, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুস্থ, সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম হয়ে উঠতে পারে।
মো. আশিকুর রহমান : সমাজকর্মী