কৃষি প্রধান দেশ এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকা সত্ত্বেও সব সময় অবহেলিত এই খাতে সম্পৃক্ত মানুষরা। স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে প্রায় সময়ই কৃষকরা ছিলেন অবহেলিত ও নানা বৈষম্যের শিকার- যা এখনো চলমান একটি প্রক্রিয়া। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের কৃষকরা উৎপাদন এবং পণ্য বাজারজাত ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বর্তমান সময়ে উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজার ব্যবস্থায় ভারসাম্য না থাকায় কৃষকের জন্য অন্যতম একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন এবং বাজার ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘদিনের চলমান প্রক্রিয়া- যা ভুক্তভোগী একমাত্র প্রান্তিক কৃষকরা।
আমাদের দেশের অর্থনীতি সাধারণত মুক্তবাজার ব্যবস্থানির্ভর। মুক্তবাজার ব্যবস্থায় সাধারণত সব প্রক্রিয়া সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত থাকে। ফলে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ের সব ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া অদৃশ্য হাত দ্বারা পরিচালিত হয়। বাজার পর্যায়ে তৈরি হওয়া বিভিন্ন সিন্ডিকেটের প্রভাবে কৃষকরা দিনের পর দিন তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিপরীতে সিন্ডিকেট চক্র কৃষকের কষ্টের ফসলকে পুঁজি করে স্থান ও সময়ের ব্যবধানে কয়েকগুণ বাড়তি মুনাফা অর্জন করছে।
বিগত কয়েক বছরে কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে উলেস্নখযোগ্য হারে। কিন্তু উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও সেই তুলনায় বৃদ্ধি পায়নি কৃষকের জীবনযাত্রার মান। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌসুমি সবজির দাম বাজার পর্যায়ে উৎপাদন খরচের তুলনায় নিম্নমুখী। যার প্রভাব সরাসরি কৃষকের ওপর পড়েছে এবং তারা নানা ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। নিম্নমুখী বাজারের কারণে কৃষকের কষ্ট বেড়েছে এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের সঠিক দাম না পাওয়ায় কষ্টে উৎপাদিত ফসল মাঠে নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রে উঠে এসেছে কৃষকের কষ্ট আর দুর্দশার প্রতিচ্ছবিগুলো। গণমাধ্যমগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে উৎপাদন খরচের তুলনায় নিম্নমুখী বাজারের কারণে কৃষকের উৎপাদিত ফুলকপি মাঠেই নষ্ট হচ্ছে। শুধু ফুলকপি নয়, বর্তমানে সবজির বাজারে প্রায় সবকিছুর দাম তুলনামূলক কম। নিম্নমুখী দামে সাধারণ ক্রেতারা স্বস্তিতে থাকলেও কৃষকের কষ্ট বেড়েছে। কারণ হিসেবে দায়ী বাজার পর্যায়ে সবকিছুর দাম নিম্নমুখী হলে কৃষি পণ্য উৎপাদন সামগ্রীর দাম বিগত কয়েক বছরের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজারমূল্য পতনের বেশ কিছু কারণের মধ্যে কৃষকদের কাছে সব সময় পর্যাপ্ত বাজার পূর্বাভাস বা পরিকল্পনা থাকে না। ফলে, কৃষকরা একে অপরকে দেখে বেশি পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করেন- যা বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ ঘটায়। যা পরবর্তী সময়ে পণ্য বিক্রিতে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে। আবার কৃষকের উৎপাদিত পণ্য শহর বা বাজারে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে পরিবহণ বা মজুত সমস্যার কারণে বাজার পর্যায়ে প্রভাব পড়ে। অনেক প্রান্তিক কৃষকরা ঋণ নিয়ে কৃষিকাজ করেন। তাই, বাজারমূল্য কমে গেলে তারা সঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না, যা কৃষকদের মাঝে একটি মানসিক চাপ তৈরি করে।
কৃষকদের সমস্যাগুলো সমাধানে প্রয়োজন সরকারি পর্যায় থেকে কৃষি পণ্য বিক্রির বিকল্প বাজার ব্যবস্থা তৈরি করা- যাতে তারা সঠিক মূল্য পায়। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও সহায়তার ব্যবস্থা করাও জরুরি। কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো বিষয়ে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বাজার পর্যায়ে বিক্রির সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া বিভিন্ন সিন্ডিকেট ও পরিবহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চাঁদাবাজি শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় সব সময়ই কৃষক থেকে গেছে অবহেলিত। দেশের বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন ঘটলেও এখনো তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি কৃষকের জীবনযাত্রার মানে। অতীত এবং বর্তমান বিবেচনা করলে দেখা যায় কৃষকরা প্রকৃতই ভুক্তভোগী।
মনে রাখতে হবে, কৃষক বাঁচলে বাচবে দেশ। কৃষককে অবহেলায় রেখে সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই কৃষকের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বাজারের ভারসাম্য বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি। সরকারিভাবে কৃষি বিভাগের উদ্যোগ এবং সঠিক পরিকল্পনা কৃষকদের দীর্ঘদিনের এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে সহায়ক হতে পারে।
মো. মুজাহিদুল ইসলাম :শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ