নানা ধরনের উদ্যোগ ও তৎপরতা সত্ত্বেও মানবপাচার রোধ হচ্ছে না- যা উদ্বেগজনক। খবরে প্রকাশ, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাগরপাড়ের ইউনিয়ন বাহারছড়া এখন মানবপাচারের প্রাণকেন্দ্র। তথ্য মতে, পাচারকারীদের মারধরে একজন ভুক্তভোগী নিহত হয়েছেন। ডেরা থেকে পালাতে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে আহত হয়েছেন আরো পাঁচজন। নিখোঁজ রয়েছেন একজন। সর্বশেষ ওই এলাকা দিয়ে পাচারকালে গত সোমবার রাতেও ১৯ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করেছে পুলিশ ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। এ সময় তিন পাচারকারীকে আটকও করা হয়েছে। এছাড়াও সাগরপথে পাচারকালে গত তিন মাসে দুই শতাধিক মানুষ উদ্ধার হয়েছেন।
যখন এই তথ্যগুলো আসছে, তখন এর ভয়াবহতা আমলে নেওয়া জরুরি। একইসঙ্গে মানবপাচার রোধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের সাগরপথ দিয়ে মানবপাচার একপ্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মানবপাচারে আবার আশঙ্কাজনকভাবে গতি ফিরেছে। কক্সবাজারের সাগরপথে মানবপাচারের এই গতির কারণ হিসেবে জানা যায়, ঘটনাগুলো কিছুটা মৌসুমি এবং কিছুটা বৈশ্বিক। বর্ষা মৌসুমে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকে। বর্ষা বিদায়ের পর নভেম্বর মাস থেকে কক্সবাজারের উপকূল দিয়ে পাচারের বাজার রমরমা হয়ে ওঠে। ফলে, এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে মানবপাচার রোধে তৎপর হতে হবে।
উলেস্নখ্য, বৈশ্বিক পরিস্থিতি যখন প্রতিকূলে থাকে, তখন আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র ঘাপটি মেরে থাকে। মানবপাচারের বিষয় নিয়ে নানা দেশে যখন মাতামাতি বেশি হয়, তখন পাচারকারীরা একপ্রকার চুপসে যায়। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশকেন্দ্রিক পাচারও বেড়ে যায়। শুধু কক্সবাজার সমুদ্রপথ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধ গমনে অনেক বাংলাদেশি সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। উন্নত জীবনের আশায় দাদালদের খপ্পরে পড়ে নানা প্রলোভনে সর্বস্ব হারিয়েছে অনেকে। মানবপাচার বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা। কেননা, জল-স্থল-আকাশপথে বিভিন্নভাবে মানবপাচার চলছে। মূলত জীবন ও জীবিকার কারণে, দারিদ্র্যের পীড়নে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এসব মানুষের বেশিরভাগই প্রতারিত হচ্ছে। অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাপথে মারা যাচ্ছেন। এমন মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে সাগর পথে বিদেশে পাড়ি জামাতে নৌকাডুবিতেও প্রাণ হারিয়েছে মানুষ। মানবপাচারের শিকার হওয়ার পর বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন অনেকে; যাদের অনেকে অমানসিক নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন।
আবার যখন কক্সবাজারের সাগরপথ দিয়ে মানবপাচারে গতি ফিরেছে, তখন এর পরিপ্রেক্ষিতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ জরুরি। জানা যায়, টেকনাফের পাহাড়ঘেঁষা ও উপকূলীয় বাহারছড়া ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কচ্ছপিয়া, বড়ডেইল ও বাঘঘোনা নামের তিনটি গ্রামে আছে মানবপাচারকারীদের ডেরা। পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি করা এসব ডেরায় দূরদূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ ও শিশুদের এনে বন্দি করে রাখা হয়। ঘরগুলোতে একবার ঢুকলে আর বের হওয়ার সুযোগ থাকে না। মাসের পর মাস ধরে পাচার করার জন্য লোকজনকে এসব ঘরে আটকে জিম্মি করে মারধর করা হয়। আদায় করা হয় টাকা। এই বিষয়গুলো ভীতিপ্রদ। যা আমলে নিয়ে মানবপাচার রোধে কঠোর হতে হবে।
সর্বোপরি, মানবপাচার ঠেকাতে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ পদক্ষেপ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে পাচারকারীদের শনাক্ত ও অভিযান পরিচালনা করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারের সাগরপথে মানবপাচার সংক্রান্ত যে তথ্যগুলো উঠে আসছে তা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে এমনটি কাম্য।