মার্চ বাঙালির জীবনে এক অনন্য মাস। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় মার্চের প্রতিটি দিনই অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং তাৎপর্যময়। এবারের ১৭ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে মুজিববর্ষ। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করবে গোটা জাতি।
মার্চের গুরুত্ব বিবেচনায় রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন সারা মাসজুড়েই নানা কর্মসূচি পালন করে। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চে পাকজান্তার সার্চ লাইট অপারেশন চালিয়ে নির্বিচারে বাঙালি নিধন, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমপাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সর্বোপরি মুক্তিকামী জনতা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য আনুষ্ঠানিক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে এই মার্চ থেকেই। ৬৯-এর গণঅভু্যত্থানের পর বাঙালি যে তার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায় এই মার্চেই। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় অনেক কিছু। যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু তার বজ্র নিনাদ কণ্ঠে ঘোষণা করেন 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এই ঘোষণার পর বাঙালির মধ্যে দেখা গেল এক নতুন উজ্জীবন। তাদের আর বুঝতে বাকি রইল না স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে এবার একটা কিছু করতেই হবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বঙ্গবন্ধু যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন। 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি' বলে তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। এই দুর্গ গড়ে তোলার অর্থ যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশনা তা বুঝতে কারও বাকি রইল না। শত্রম্নর মোকাবেলা করার দৃপ্ত আহ্বানও ভেসে উঠল তার বজ্রকণ্ঠে। সেনাবাহিনীর প্রতিও তিনি উচ্চারণ করলেন সতর্ক বাণী। প্রয়োজনে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার কথাও বললেন তিনি। ৭০-এর নির্বাচনে যে ম্যান্ডেট তিনি পেয়েছিলেন বস্তুত সেই ম্যান্ডেটই তাকে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। যে কারণে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ড দিতে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাকিস্তানের শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়েছিল দীর্ঘদিন থেকে। এ দেশের তরুণ-তরুণী, আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই সেদিন এই একটি কণ্ঠের মন্ত্রমুগ্ধে আবিষ্ট হয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যার যার মতো করে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। স্বাধীনতা এবং মুক্তির ঐকতানে বাঙালি জাতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ, আবালবৃদ্ধবণিতা নির্বিশেষে এক হয়। এরই মধ্যে নানা কূটকৌশল চালাতে থাকে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে চতুরতার সঙ্গে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে তারা।
এভাবেই ঘনিয়ে আসে ২৫ মার্চের কালরাত্রি। পাকজান্তারা ভারী অস্ত্র, কামান নিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের নামে এ দেশের ছাত্র, জনতাসহ নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও হামলা চালায়। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রতু্যষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে গোটা জাতি। যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে তারা শত্রম্নর মোকাবিলা করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষ। শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। অতঃপর একসাগর রক্তের বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভ। অবসান হয় ২৩ বছরের বৈষম্য আর বঞ্চনার। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয়।
দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার করল বাংলাদেশ। এ বছর মার্চ এসেছে এমন এক সময় যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার সরকার তৃতীয় মেয়াদে প্রথম বছর পার করছে। বাংলাদেশ নানাভাবেই এগিয়ে গেছে। মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উড়ছে। এর ফলে স্যাটেলাইটের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। রূপপুর পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে পারমাণবিক বিদু্যৎ যুগেও এখন দেশ। এ ছাড়া মাতৃমৃতু্য ও শিশু মৃতু্যর হার কমেছে। যোগাযোগব্যবস্থায়ও এসেছে উন্নয়ন। উড়াল সড়ক দৃশ্যমান এক উন্নয়ন বাস্তবতা। মেট্রোরেল, বাসর্ যাপিড ট্রানজিটের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে আমরা প্রবেশ করেছি ফোরজির যুগে। ফাইভজি এলো বলে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ পর্যায়ে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন অনেকটাই দৃশ্যমান বাস্তবতা। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ প্রত্যাহার এবং নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা ঘোষণা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় সংকল্প নেতৃত্বের সাহসের প্রতীক। দেশাত্মবোধেরও জাগরণ সৃষ্টি হয় পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে প্রায় ৩৫ কোটি নতুন বই তুলে দিয়ে পাঠ্যপুস্তক দিবস পালন করা হচ্ছে। এ বছরও পহেলা জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক দিবস পালন করা হয়।
তবে এটি ঠিক সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও রাজনৈতিক অনৈক্য, সংঘাত, সহিংসতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস এক প্রধান সমস্যা হিসেবেই এখানে রয়ে গেছে। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির সহাবস্থান সম্ভব নয় বলেই এই সংকট দূর হচ্ছে না- এমনটিই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বারবার। এসব সমস্যা উজিয়ে একটি আদর্শিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছাতেই হবে। তবেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের মূলে আছে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে আস্থাহীনতা। সেটা জাতীয় নির্বাচনই হোক, আর স্থানীয় নির্বাচনই হোক। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কিংবা কার অধীনে হবে- এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার জন্য। এরই মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বেশ কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো নির্বাচনই সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়ও বাতিল হয়েছে। এ অবস্থায় মনে রাখতে হবে যখন সংকটের মূলে নির্বাচনব্যবস্থা তখন যে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন কারান্তরীণ। এ নিয়ে রাজনৈতিক মাঠ এখন বেশ উত্তপ্ত। রাজনৈতিক অনৈক্য ও সহিংসতা বজায় রেখে কোনো অবস্থায়ই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্য সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
মার্চ মাসেই বাঙালি তার চেতনাকে নতুন করে শানিত করে। এবারের মুজিববর্ষে নতুন শপথে বলীয়ান হোক সবাই। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদকমুক্ত করতে হবে দেশকে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত হয়ে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তবেই মুজিববর্ষের সার্থকতা।
অত্যাচার, নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্মারক মাস হিসেবে মার্চ প্রতিবারই আমাদের নতুন করে পথ দেখায়। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব দেশপ্রেমিক দলকে চেতনাদীপ্ত মার্চে নতুন করে শপথ নিতে হবে। সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তবে তা করতে হবে রাজনৈতিক সংহতি এবং ঐক্য বজায় রেখেই।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট
যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ুধযড়ড়.পড়স