বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প

নতুনধারা
  ০৮ মার্চ ২০২০, ০০:০০
বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প

ভারতের বিতর্কিত নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারীদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে চলছে তুমুল সংঘর্ষ। গত রোববার থেকে এ সংঘর্ষ রূপ নেয় দিলিস্নর কয়েক দশকের মধ্যে ঘটা ছোটখাটো সহিংসতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়াবহ সহিংসতায়। বর্তমান বিজেপি সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, প্রতিবেশী দেশগুলোর হিন্দু সংখ্যালঘুদের তারা নাগরিকত্ব দেবে। সংশোধিত বিল অনুযায়ী তাদের অবশ্যই ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর আগে ভারতে প্রবেশ করতে হবে এবং ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার বা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে ধর্মীয় নিপীড়নের ভীতি প্রদর্শন করলে তবেই ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারবেন। ওই বিলের উদ্দেশ্য ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পারসি ও জৈন ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু এ বিলে মুসলমানদের জন্য এজাতীয় কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এ বিল পাশের পর ভারতজুড়ে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিকমহল এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে উক্ত আইনে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় বৈষম্যের শিকার হয় এবং তা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি।

নরেন্দ্র মোদির বিগত শাসনামলে সাম্প্রদায়িক রূপ এতটা প্রকট আকারে না দেখা গেলেও, এবার নির্বাচিত হয়ে বিজেপি ও মোদির সাম্প্রদায়িক রূপ স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে। গো-হত্যার অভিযোগ দিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে হতদরিদ্র মুসলমানদের উপর চালানো হয়েছে হিংস্র আক্রমণ এবং এর ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এর জন্য কারও তেমন শাস্তি বা বিচার হতে দেখা যায়নি। তাছাড়াও সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে, কাশ্মীরীদের অধিকার হরণ করা হয়। ভারতের ইতিহাসভিত্তিক বইগুলোতে আনা হয়েছে আমূল পরিবর্তন, মুসলিম শাসনামলকে দেখানো হয়েছে অত্যাচারী শাসনামল হিসেবে। মুসলিম শাসকদের শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন স্থানের নাম পরিবর্তন করে সেগুলোকে বৈদিক যুগের নামে নামকরণ করা হচ্ছে। যেমন- এলাহাবাদ শহর নাম পরিবর্তন করে 'প্রয়াগ নগর' করা হয়েছে। বাবরি মসজিদসংক্রান্ত রায়, যা ওই এলাকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের ভীষণভাবে হতাশ করেছে। এই যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো, বিজেপি নেতারা তা শুরু করেন ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রচার অভিযান থেকে। তারা সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুত্ববাদকেই ব্যবহার করেই নির্বাচনে জয়লাভ করেছে।

ক্ষমতা লাভের পর প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয় আসামের বহ্মপুত্রের অববাহিকায় বসবাসরত দরিদ্র মুসলিমরা। যারা শত শত বছর ধরে আসামে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে, তাদের নাগরিকত্বই অবৈধ ঘোষণা করা হলো। এরপর অমিত শাহের ঘোষণা অনুযায়ী সারা ভারতজুড়ে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হলো, যা ভারতীয় সংসদে সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বা নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নামে উত্থাপন করা হলো। সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। ভারতের অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ সাংসদ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব ভারতজুড়ে এর প্রতিবাদ করেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ওড়িষার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পাটনায়কসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের সরকারপ্রধান এর বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু বিজেপি সংসদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিলটি ভারতীয় সংসদে পাস করিয়ে একে 'সিটিজেন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ)'-তে পরিণত করে।

শুরু থেকেই ভারতের তরুণ সমাজের বিরোধিতা করে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ আইনের বিপক্ষে আন্দোলনে নামে। দিলিস্নর জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত ও সমাদৃত, সেখানকার শিক্ষার্থীরা ছিল সবচেয়ে বেশি সরব। তার সঙ্গে যুক্ত জামিয়া মিলিস্নয়া বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও তাদের এ আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, শালীন, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ। কিন্তু বিজেপি ও তার অঙ্গসংগঠন এ আন্দোলনকে প্রথম থেকেই সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে এবং আরএসএসের গুন্ডা বাহিনী ও পুলিশ তাদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। কিন্তু গত রোববার থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গা, যা ভারতে গত কয়েক দশকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংঘাত থেকে ছিল বহুগুণ ভয়াবহ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানা যায়, এ পর্যন্ত ৪২ জনের মৃতু্য ও ৩০০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে, যার অধিকাংশই ছিল মুসলিম। মুসলিমদের ওপর এসিড আক্রমণ, তাদের বাড়িঘর ভাংচুর, ঘরে মানুষ রেখে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার মতো বর্বর ঘটনাও ঘটেছে। মসজিদে আগুন ও ভাংচুর, ধর্মীয় গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়া ও মসজিদের মিনারে হনুমানের পতাকা ওড়ানো হয়েছে। নয়াদিলিস্নতে যখন সহিংসতার আগুন জ্বলছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন নৈশভোজে ব্যস্ত ছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খাতির-যত্ন শেষে চার দিন পর মোদির হুঁশ ফেরে, তিনি টুইট করে শান্তি কামনা করেন। সহিংসতায় দিলিস্ন পুলিশের ভূমিকা সবাইকে বিস্মিত করেছে। তারা হয় দাঁড়িয়ে থেকেছে আশ্চর্য নির্লিপ্ততা নিয়ে, নয়তো নিজেরা নির্যাতনকারীর দলে যোগ দিয়েছে। পুলিশের নিকট সাহায্যের জন্য হাজার হাজার ফোন কল করে ও সাহায্য পায়নি নির্যাতিতরা। যে হিন্দু-মুসলিমরা একসঙ্গে সারাজীবন কাটিয়েছেন, একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে সমাজ বিনির্মাণে কাজ করেছেন, একে অন্যের আপদে-বিপদে এগিয়ে এসেছেন, যে দিলিস্নতে একসঙ্গে মসজিদ মন্দিরের অবস্থান ছিল। সে হিন্দু- মুসলিমদের মধ্যেই এখন বিবেদ তৈরি হয়েছে, একে অন্যের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। যার মূলে রয়েছে বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক মনোভাব, তাদের নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য। দেশটিতে এর আগেও এই রাজনীতি বড় বড় ট্র্যাজিক ঘটনার কারণ হয়েছে, যা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং এ ধরনের ভ্রাতৃঘাতী ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার প্রয়াস ও প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তা যে ঘটেনি, সেটা এক বিরাট পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়। দিলিস্নর সহিংসতার শিকার হয়েছে মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, যা নিজেকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, এবং যেখানে এ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঐতিহ্য ছিল, সেখানে এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা দুর্ভাগ্যজনক ও গস্নানিকর বিষয়। ভারতবর্ষে সম্রাট আকবর থেকে অশোক একটাই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে চলেছে। সেটা হলো বহুত্ববাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দীন-ই-ইলাহি ধর্মের পথ। অমর্ত্য সেন তার 'তর্কপ্রিয় ভারতীয়' গ্রন্থে যাকে ভারতীয় উপনিষদের আলোয় বিশ্লেষণ করেছেন। যদি সেই ভারতকে প্রতিষ্ঠিত করতে নরেন্দ্র মোদি সফল হন একমাত্র তখনই বোধহয় তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হবেন ক্ষমতার সিংহাসনে। তার বদলে যদি মেরুকরণের রাজনীতির নামে, নির্বাচনী ফায়দার লোভে বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার তাস সুকৌশলে খেলতে উদ্যত হয়, সাম্প্রদায়িকতার নীল বিষ ছড়িয়ে মোদি বা বিজেপি সরকার যদি তার আসন পাকা করতে চায়, তা হলে তারা নিক্ষিপ্ত হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। ইতিহাস কখনো তাদের ক্ষমা করবে না।

মোজাম্মেল হক

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<91565 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1