ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিশ্বের মানুষ দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত, একটি আস্তিক যারা সৃষ্টিকর্তায় বা ধর্মীয় আচারে বিশ্বাস করে এবং অন্যটি নাস্তিক যারা এসব বিশ্বাস করে না। তবে এ দুটোর মাঝামাঝি তৃতীয় আরও একটি সম্প্রদায়ের কথা শোনা যায় যারা পুরোপুরি বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনোটাই করে না। আস্তিকের মধ্যে রয়েছে আরও কিছু উপবিভাগ। যেমন- মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি ইত্যাদি। ধর্মপ্রাণ প্রতিটি মানুষের কাছে ধর্ম একটি আবেগ অনুভূতির স্থল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- এই ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রেষারেষি, খুনখারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা এমনকি যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত আমরা অতীতের বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি এবং এখনো করছি। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কি তাহলে ধর্মের শিক্ষা? মোটেও বিষয়টি তা নয়। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে শান্তির বার্তা। সহিংসতার সঙ্গে ধর্মের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই। সংক্ষেপে বলতে গেলে, মুসলিম সম্প্রদায়ের মহাগ্রন্থ আল কোরআনে রয়েছে- 'অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার চালায় এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।' (সূরা আশ শুরা, ৪২:৪২) অবশ্যই অত্যাচারীদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে। (সূরা ইব্রাহীম, ১৪:২২) আলস্নাহ অত্যাচারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আল ইমরান, ০৩:১৪০) উপরের আয়াত হতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা মানুষের ওপর অত্যাচার করতে নিষেধ করেছেন। আর এখানে মানুষ বলতে নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ নয়, সমস্ত মানব জাতিকেই বোঝানো হয়েছে। আবার ইসলামের ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে গেছেন। হিন্দু ধর্মের গীতায় রয়েছে, যে যথা মাং প্রপদ্যান্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম, মম বর্ত্মানুবর্তস্তে মনুষ্যা : পার্থ সর্বশঃ (শ্রী গীতা, জ্ঞানযোগ, শ্লোক-১১, পৃ. ১২৮) যে আমাকে যেভাবে উপাসনা করে, আমি তাকে সেভাবেই তুষ্ট করি। মনষ্যগণ সর্বপ্রকারে আমার পথেরই অনুসরণ করে। অর্থাৎ, মানুষ যে পথই অনুসরণ করুক না কেন, সব পথেই আমাতে পৌঁছতে পারে। এ শ্লোকে যে হিন্দুধর্মের সম্প্রীতি বার্তা রয়েছে তা অত্যন্ত স্পষ্ট। গীতা শাস্ত্রী জগদীশ চন্দ্র ঘোষ উপরোক্ত শ্লোকের ভাষ্যে বলেন, 'বর্তমান যুগ ধর্ম সমন্বয়ের যুগ। ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ সমন্বয় ধর্মের প্রধান উপদেষ্টা ও পথ প্রদর্শক। 'যত মত তত পথ'- ইহাই তাহারই উপদেশ। পৃথিবীতে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিষ্টান- কত রকম ধর্মমত প্রচলিত আছে। গীতার এই একটি শ্লোকের তাৎপর্য বুঝিলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত পার্থক্য থাকে না। হিন্দুর হৃদয়ে ধর্ম বিদ্বেষ থাকিতে পারে না।' বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি হলো অহিংসা। বৌদ্ধ ধর্মের ত্রিপিটকে আটটি সৎ পথের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- ১. সৎ দর্শন, ২. সৎ আকাঙ্ক্ষা ৩. সৎ কথন ৪. সৎ আচরণ ৫. সৎ জীবন-যাপন ৬. সৎ প্রচেষ্টা, ৭. সৎ মনোযোগ ৮. সৎ ধ্যান। কেউ যদি এই আট পথের পথিক হয়, তাহলে তো তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও হিংসা-বিদ্বেষের কথা থাকতে পারে না। খ্রিষ্টধর্মে প্রেমকে বড় করে দেখানো হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে, ঈশ্বরই প্রেম।' খ্রিষ্টধর্ম প্রেমের ধর্ম। খ্রিষ্টানরা মনে করেন, প্রত্যেকের মধ্যেই খ্রিষ্ট বিরাজ করছেন। ক্ষুদ্রতমের মধ্যেও তিনি আছেন। বাইবেলের মথি পুস্তকের ২৫তম অধ্যায়ের ৩৫ থেকে ৪৫নং শ্লোকগুলোর ভাষ্যে তা পাওয়া যাবে। ধর্ম মানুষকে বিপথগামী করে না বরং নিজস্ব অজ্ঞতার জন্য মানুষ ধর্মান্ধ হচ্ছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিঘ্নিত হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ধর্মকে জানা ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এক বিরাটসংখ্যক মানুষ নিজ ধর্ম সম্পর্কে জানে না এবং ৯৯ শতাংশ মানুষই অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানে না। সত্যিকার অর্থে মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও হিন্দু হতে পারলে সারাবিশ্বে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটত না।
ইহুদি ধর্মের ১০টি নির্দেশের মধ্যে ষষ্ঠ নির্দেশ হচ্ছে, 'কাউকে হত্যা করো না'। ইহুদিরা যদি তাদের ধর্মের এ বাণী মানত, তাহলে ফিলিস্তিনে মানুষ হত্যা করতে পারত না। প্রত্যেক ধর্মেই ধর্ম প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও সহিংসতার মাধ্যমে এ কাজ করতে বলা হয়নি। নানা ফুল, নানা রূপ, নানা গন্ধ সব মিলিয়ে হয় বাগান।
একইভাবে নানা ধর্ম, নানা বর্ণ, নানা সম্প্রদায়ের মানুষের নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে পারস্পরিক সহাবস্থানই মানবসভ্যতার মূল কথা। পৃথিবীর সব মানুষ যদি একই বিশ্বাস ধারণ করে, তবে তো সভ্যতা থমকে যাবে। প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে মানুষের মধ্যে নানা বৈচিত্র্য। এ বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। বরং এ বৈচিত্র্যের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমেই উন্নতি ও প্রগতি সাধন সম্ভব। নানা বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিষোদগার, বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ, অশ্রদ্ধা কখনো স্বধর্মের মাহাত্ম্য বাড়াই না। বরঞ্চ এর মাধ্যমে আপনধর্মেরই সম্মানহানি হয়। একজন প্রকৃত ধার্মিক কখনো ভিন্নধর্মকে অশ্রদ্ধা করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি স্বধর্মের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল আমার কাছে তা পরিমাপের সবচেয়ে সহজ মানদন্ড হলো সে ব্যক্তি পরধর্মের প্রতি কতটা উদার মানসিকতাসম্পন্ন। সবশেষে বরেণ্য শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি : 'মানুষের জন্য যাহা কল্যাণকর, তাহাই ধর্ম। যে ধর্ম যাপন করিতে গিয়া মানুষের অকল্যাণ করিতে হয়, তাহা ধর্মের কুসংস্কার মাত্র। মানুষের জন্য ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়।'
কাজী আশফিক রাসেল
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Copyright JaiJaiDin ©2021
Design and developed by Orangebd