সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

বড় কাটরা, ছোট কাটরা
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

কাটরা বা কাটারা এর আরবি ও ফার্সি অর্থ হলো ক্যারাভ্যানসারাই বা অবকাশযাপন কেন্দ্র। বাংলাদেশের ঢাকায় মুঘল শাসনামলে দুটি অন্যন্য কাটরা নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে একটি হলো বড় কাটরা ও অপরটি হলো ছোট কাটরা।

বড় কাটরা

বড় কাটরা ঢাকায় চকবাজারের দক্ষিণে অবস্থিত মুঘল আমলের একটি সরাইখানা।

সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে (হিজরি ১০৫৫) বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়। দিওয়ান (প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা) মীর আবুল কাসিম দ্বারা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়। যিনি মীর-ই-ইমারত নামে পরিচিত ছিলেন। প্রথমে এতে শাহ সুজার বসবাস করার কথা থাকলেও পরে এটি মুসাফিরখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুঘল আমলে এটি নায়েবে নাজিমদের বাসস্থান তথা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এটি চকবাজারের পাশেই অবস্থিত। বর্তমানে এটি জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম, বড় কাটরা মাদ্রাসার তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

এক সময় স্থাপত্য সৌন্দর্যের কারণে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় বড় কাটরার তোরণে ফার্সি ভাষায় শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজী লিখিত একটি পাথরের ফলক লাগানো ছিল। যেখানে এই মুসাফির খানার নির্মাতা ও এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় নির্বাহের উপায় সম্পর্কে জানা যায়।

বিল্ডিংটি মধ্য এশীয় সরাইখানার ঐতিহ্যবাহী প্যাটার্ন অনুসরণ করে এবং মুঘল স্থাপত্য অনুযায়ী শোভিত। মূলত এটি একটি চতুষ্কোণ অঙ্গন ঘেরা স্থাপত্য।

দক্ষিণ শাখাটি ৬৭.৯৭ মিটার প্রসারিত এবং বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। উত্তর বাহুও একই মাপের ছিল বলে ধারণা করা হয়। পূর্ব-পশ্চিম বাহুর দৈর্ঘ্য এখন নিরূপণ করা দুঃসাধ্য হলেও আদিতে ৭০.১০ মিটার করে ছিল বলে জানা যায়। তিন তলা বিশিষ্ট এ সদর তোরণ ছিল অতি মনোমুগ্ধকর এবং এটি দক্ষিণে নদীর দিকে প্রায় ৭.৬১ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১২.১৯ মিটার প্রসারিত ছিল। এ প্রবেশপথের দু'পাশে ছিল দুটি প্রহরীকক্ষ। প্রহরীকক্ষ দুটির আয়তন ছিল পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ৫.৫১ দ্ধ ২.৯২ মিটার। এ প্রবেশপথের পরে ছিল পরপর তিনটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আয়তনের প্রবেশপথ। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা প্রবেশপথের আয়তন ছিল যথাক্রমে ২.৭৪ দ্ধ ০.৯১ মি., ৩.৩৫ দ্ধ ১.৮২ মি, এবং ২.৭৪ দ্ধ ১.৮২ মি.।

বড় কাটরার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুইটি প্রবেশ পথ রয়েছে। আয়তাকার প্রাঙ্গণ ঘিরে নির্মিত বড় কাটরার কক্ষের সংখ্যা মোট বাইশটি। পূর্ব-পশ্চিম অংশের মাঝামাঝি তিন তলা সমান উচ্চতার ফটকের দুইপাশে দ্বিতল ঘরের সারি এবং দুইপ্রান্তে আটকোনা দুইটি বুরুজ রয়েছে।

কথিত আছে, শাহজাদা শাহ সুজার জন্য এই প্রাসাদটি নির্মাণের পর তার পছন্দ না হওয়ার কারণে স্থপতি আবুল কাসেমকে শর্ত সাপেক্ষে ব্যবহার করার জন্য দিয়ে দেন। শর্ত ছিল যে, দানকৃত ওয়াকফ ইমারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহারের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো প্রকার ভাড়া বা অর্থ নিতে পারবে না। তাই বাইশটি দোকানির নিকট ওয়াকফ করা দোকান বড় কাটরার খরচ নির্বাহের জন্য দেওয়া হয়।

ছোট কাটরা

সুবেদার শায়েস্তা খান ছোট কাটরা নির্মাণ করেছিলেন। আনুমানিক ১৬৬৩-১৬৬৪ সালের দিকে এ ইমারতটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং এটি ১৬৭১ সালে শেষ হয়েছিল। এটির অবস্থান ছিল বড় কাটরার পূর্বদিকে হাবিবুর রহমান লেনে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলে বেশ কিছু অংশ সংযোজন করা হয়েছিল।

ছোট কাটরা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি ঢাকায় একটি ইমারত। ইমারতটি দেখতে অনেকটা বড় কাটরার মতো হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটরার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটরা। তবে ইংরেজ আমলে এতে বেশ কিছু সংযোজন করা হয়েছিল। ১৮১৬ সালে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক লিওনার্দ এখানে ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল খুলেছিলেন।

বর্তমানে ছোট কাটরা বলতে কিছুই বাকি নেই শুধু একটি ভাঙা ইমারত ছাড়া। যা শুধু বিশাল তোরণ মতন সরু গলির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে অসংখ্য দোকান এমনভাবে ঘিরে ধরেছে, দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে মুঘল আমলের এমন একটি স্থাপত্য ছিল।

সায়েস্তা খানের আমলে ছোট কাটরা নির্মিত হয়েছিল সরাইখানা বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য। কোম্পানি আমলে ১৮১৬ সালে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক লিওনারদ ছোট কাটরায় খুলেছিলেন ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল। ১৮৫৭ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকার প্রথম নরমাল স্কুল। উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের প্রথম দিকে ছোট কাটরা ছিল নবাব পরিবারের দখলে। এবং তাতে তখন 'কয়লা ও চুনার কারখানার কাজ' চলত।

ছোট কাটরার সঙ্গে বিবি চম্পার স্মৃতিসৌধ অবস্থিত ছিল। এক গম্বুজ, চার কোনা, প্রতিপাশে ২৪ ফুট দীর্ঘ ছিল স্মৃতিসৌধটি। বিবি চম্পা কে ছিলেন তা সঠিক জানা যায়নি। তবে কারো মতে তিনি শায়েস্তা খার মেয়ে। বর্তমানে, ছোট কাটরাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এখনো এর ধ্বংসাবশেষ দেখলে বোঝা যায় মুঘল আমলে নদী তীরে দাঁড়িয়ে থাকা কাটরাকে কী সুন্দরই না দেখাত!

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে