শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে কবরী

মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
শনিবার বাদজোহর গার্ড অব অনার দেওয়া হয় কবরীকে

১৯৭১ সাল। চলচ্চিত্রে অভিষেকের মাত্র ছয় বছর পরেই শুরু হলো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। বানের পানির মতো ভেসে গিয়েছিল এ দেশ থেকে লাখ লাখ শরণার্থী ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্যগুলোতে। যুদ্ধ-পূর্বের শেষ ছবি 'স্মৃতিটুকু থাক'। একে তো সামনে পড়ে আছে দীর্ঘ সোনালি ক্যারিয়ার। তখন যুদ্ধ না চাওয়ারই কথা। আর বয়েসই বা কত? মাত্র উনিশ কি বিশ। কিন্তু মিষ্টি হাসির মিষ্টি মেয়ে সেই তরুণী বয়সেই দেশের ক্রান্তিলগ্নে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও সাহসী বীরঙ্গনার মতো সাংগঠনিক তৎপরতায় নিজের দেশপ্রেম তুলে ধরেছিলেন। শিল্পী মন নিয়ে কবরী সেখানে প্রতিদিন তাদের দেখভাল করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। এই সময়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে কলকাতার আকাশবাণীর সাংবাদিক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেন, 'বিশ্ববাসীর কাছে আমার আবেদন, আমাদের দেশে লড়াই চলছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের মা-বোনের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, দেশের মানুষকে মেরে ফেলছে। আমরা আমাদের স্বাধীনতা চাই। আমরা দেশে ফিরতে চাই। বিশ্ববাসী যেন আমাদের সাহায্য করে।' তখন তার বয়স এতই কম যে, এমন সচেতনতামূলক ভূমিকা রাখার সময়েও নিজের জনপ্রিয়তা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন না তিনি। তিনি যে তখন সেলিব্রিটি নায়িকা, জনপ্রিয় নায়িকা এই ধারণাও ছিল না তার। তিনি যে সেলিব্রিটি, সে হিসেবে যে তার ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র তুলে ধরতে, এটা কবরী মনেও করেননি। এ সম্পর্কে তিনি সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আমাদের জনপ্রিয়তা নিয়ে বলতে গেলে, আমরা, বিশেষ করে আমি যে বয়সে কাজ শুরু করেছি, তখন এসব আমরা বুঝতামই না। এখন অনেক টকশোতে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, 'আপনি যখন সেলিব্রেটি ছিলেন', আরে সেলিব্রেটি কি জিনিস এসব তো আমরা বুঝতামই না। পাবলিসিটি নিয়ে আমরা কখনো চিন্তাও করিনি।' বাস্তবতা ছিল, জনপ্রিয় হিসেবে নয়, ব্যক্তি হিসেবেই তিনি মনে করেছেন দেশ আক্রান্ত, দেশকে মুক্ত করতে হবে, স্বাধীন করতে হবে, দেশের লাখ লাখ শরণার্থীর মতো তাকেও দেশে ফিরতে হবে সেই আকুতি থেকেই সেদিনের মুক্তিযুদ্ধে যা যা তার পক্ষে করণীয় সম্ভব সবই করেছেন এই সোনালি যুগের নায়িকা। তাই বিডিনিউজকে দেওয়া তার ওই একই সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যুদ্ধের সময় শরণার্থী শিবিরে যখন গিয়েছি, আমাদের অবস্থা তখন অন্যদের চেয়ে ভালো। কারণ, ওই যে বললাম, আমরা তখন 'চিহ্নিত চেহারা'। তখনও তো যোদ্ধা হইনি। প্রাণভয়ে পালিয়েই না মুক্তিযোদ্ধা হলাম। সব লোকই কিন্তু তাই করেছে। প্রাণভয়ে পালিয়ে ওখানে গিয়ে তারপরে যুদ্ধে নেমেছে। কারণ, তখন আমরা রিয়েলাইজ করলাম, আমাদের তো যুদ্ধ করতে হবে। সবদিক থেকে যদি পাকিস্তানিদের সরাতে হয়, তাহলে তো মানুষের সাপোর্ট লাগবে, কাজ করতে হবে। তারই লক্ষ্যে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটা হয়েছিল।' এরপর দেশ স্বাধীন হলো। জেগে উঠল আবার এফডিসি চত্বর। দেশ স্বাধীনের পর অভিনয় করলেন 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'রংবাজ', 'ময়নামতি', 'সুজন সখী', 'সারেং বৌ', 'দেবদাস'সহ আরও অনেক কালজয়ী সিনেমায়। কিন্তু বয়েস তো আর থেমে থাকে না। ছেড়ে দিতে হলো নতুন নায়িকাদের জন্য চলচ্চিত্রপাড়া। তখন কী করবেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেই শরণার্থী শিবির থেকেই জাগ্রত ছিল। সেলিব্রিটি কি জিনিস এটা না বুঝলেও দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপট দেখেই কিন্তু সেদিনের সলজ্জ মিষ্টি হাসির কবরী তার মনের কোণে রাজনৈতিক সত্তাটিকেও ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। আর তা এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে