সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজম খানবিহীন এক যুগ

জাহাঙ্গীর বিপস্নব
  ০৫ জুন ২০২৩, ০০:০০

মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান- আমরা তাকে চিনি আজম খান নামে। আর দেশের সঙ্গীতপ্রেমিদের কাছে তিনি পপ সম্রাট। গুরু হিসেবেও আখ্যায়িত করেন তার ভক্তকুল। নানামাত্রিক, নানান পরিচয়ের এই মানুষটি একধারে একজন মুক্তিযোদ্ধা, সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা, ক্রিকেটার ও বিজ্ঞাপনের মডেল। তাকে বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের একজন অগ্রপথিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে তার অনুজ ব্যান্ডতারকা মাকসুদুল হক 'পপশিল্পী' অভিধাকে অপসংজ্ঞায়ন মনে করেন। তিনি তাকে বাংলাদেশের রক সঙ্গীতের অগ্রপথিক হিসেবে বিবেচনা করেন। তার গানের বিশেষত্ব ছিল- পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্র রীতি। ওরে সালেকা ওরে মালেকা, রেল লাইনের ওই বস্তিতে, আলাল ও দুলাল, আসি আসি বলে, অভিমানী এবং বাংলাদেশসহ অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা আজম মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় সংঘটিত কয়েকটি গেরিলা অভিযানে অংশ নেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে।

দেশের পপ ও রক সঙ্গীতের কিংবদন্তি আজম খানের মৃতু্যর ১১টি বছর পার হয়ে গেছে অনেকটা দেখতে দেখতেই। আজ ৫ জুন তার প্রস্থানের এক যুগ পূর্তি হচ্ছে। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালে এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। প্র্রতি বছরের মতো এবারও পপ সম্রাটের মৃতু্যবার্ষিকী উপলক্ষে পারিবারিকভাবে মসজিদে মিলাদ পড়ানো ও কবর জিয়ারত করা হবে বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকার আজিমপুরে জন্মগ্রহণ করেন আজম খান। '৬৯-এর গণঅভু্যত্থানে আজম খান ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে গণসঙ্গীত গেয়ে দেশের যুবসমাজকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন সাহসী গেরিলা যোদ্ধা। ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে চলে যান আগরতলায়। মেঘালয়ে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। ওই সময় গান গেয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতেন। প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন সম্মুখযুদ্ধে। খালেদ মোশাররফের অধীনে ২ নম্বর সেক্টরের একটি সেকশনের কমান্ডার করে আজম খানকে ঢাকা শহরে গেরিলা অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করতে থাকেন একের পর এক। যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন।

স্বাধীন দেশে আজম খান একাই দাঁড় করিয়ে ফেলেন সঙ্গীতের নতুন ধারা। তার গানের দলের নাম ছিল 'উচ্চারণ'। এমন উচ্চকণ্ঠের গান কখনো ছিল না আগে। সেই সঙ্গে জোরালো বাদন। বাংলা গান পায় নতুন এক প্রাণ স্পন্দন।

আজম খান যেমন দেশের পপ গানকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে দিয়েছেন নতুন ধারার এই গান। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন দেশের তরুণদের। পপ গানকে লালন করেছেন, শ্রোতা তৈরি করেছেন, বাংলা এই পপ গানের ধারা যেন সময়ের সঙ্গে প্রবাহমান থাকে, সেই পথও তৈরি করে গেছেন।

বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কথা সহজভাবে বলে গেছেন এই পপসম্রাট। এক সময় তার গানে উঠে আসে সচেতনতা, দেশপ্রেম, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়, তরুণদের উদ্বুব্ধকরণের মতো বিষয়। কিন্তু নানা পরিস্থিতিতে গান চালিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চলতে থাকে তার গান।

অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দেওয়া আজম খানের গান করার শুরুটাও হঠাৎ করেই। গান করে যাবেন- এমন কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তার। স্কুলে পড়ার সময় পিটিতে সবার সঙ্গে গান গাইতেন। এসব গান মনে রাখতে পারতেন আজম খান। যে গান ভালো লাগত, সেটাই শুনতেন, পরে হুবহু সেটা গাওয়ার চেষ্টা করতেন। আজম খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমি গান শুনে হুবহু গাইতে পারতাম। অনেকের কাছে এটা বিস্ময়কর ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, আবদুল আলিম, শ্যামলের গান তাদের মতো করেই গাইতাম। পরে মহলস্নার বন্ধু-সমবয়সিদের সঙ্গে আড্ডায় বানিয়ে গান গাইতাম। এভাবেই এক দিন গানের দিকে ঝুঁকে পড়ি। গানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার ছিল না।'

আজম খান ছিলেন- একটা সত্যিকারের সাধারণ মানুষ। যার কোনো উচ্চাঙ্ক্ষা ছিল না। সাধারণ মানুষের মতো আজম খানের কখনোই কোনো লোভ ছিল না। বাড়ি ভাড়া আর গান করে যা পেতেন, এতেই খুশি ছিলেন। অনেক মজার মানুষ ছিলেন তিনি। বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতেন, গান করতেন। সকালে নিজে বাজার করে নিজেই রান্না করতেন। কোনো কিছুর প্রতি তার মোহ ছিল না। তিনি কখনোই কিছু প্রাপ্তির আশা করে গান গাইতেন না। তিনি গান করতেন নিতান্তই ভালোলাগা, ভালোবাসা থেকে। সশরীরে না থাকলেও তার গানগুলো আজও সমসাময়িক। এই গানগুলোই তাকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে