সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুবর্ণজয়ন্তীতে সোলস

জাহাঙ্গীর বিপস্নব
  ০৬ জুন ২০২৩, ০০:০০
সোলস পরিবার

দেশের ব্যান্ডদলগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী গানের দল 'সোলস'। যার অর্থ আত্মা। সুরের জাদুতে হাজারো মানুষকে আত্মীয়তায় বাঁধতেই হয়তো এমন নামকরণ। এই ব্যান্ডটি হাজার হাজার শ্রোতাকে দু'হাত ভরে দিয়েছে অসংখ্য গান আর অগণিত সুন্দর মনের প্রতিভাবান শিল্পী। সোলস কেবল শুধু একটি ব্যান্ড নয়, এ যেন একটি প্রতিষ্ঠান, যা থেকে জন্ম নিয়েছে এক-একজন নক্ষত্র, যারা স্বমহিমায় জ্বলছেন পরিপূর্ণ গৌরবে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশ যখন এক গভীর ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখন একদল তরুণ সাহসী যুবক যেন গানের সুরে স্তব্ধ করে দিতে চাইলেন সব অস্থিরতা। প্রথাগত সঙ্গীতচর্চাকে ভেঙে ওয়েস্টার্ন রক ঘরানার সঙ্গে বাংলার সুরজগৎকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় বিভোর হয়ে পড়েন এই তরুণের দল। দল চালানোর মতো কোনো অর্থ ও ভালো ড্রামার না থাকলেও কেবলমাত্র মনোবল আর নিজেদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থেকেই 'সুরেলা' নাম দিয়ে যাত্রা শুরু করেন তারা। আর তার পরের বছর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'সোলস', যা আজও অটুট আছে লক্ষ শ্রোতার অন্তরে।

সুব্রত বড়ুয়া, সাজেদ উল আলম ও মুমতাজুল হকের হাত ধরে প্রথম গড়ে ওঠে ব্যান্ডটি। এরপর গুটিগুটি পায়ে পথচলা শুরু সোলসের। ব্যান্ডের সদস্যদের আমন্ত্রণে নকীব খান, তপন চৌধুরী, আহমেদ নেওয়াজ ও রুডি থমাসদের আগমন। ধীরে ধীরে ব্যান্ডকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার চেষ্টা। মূলত চট্টগ্রামেই চলছিল ব্যান্ডের অনুশীলন। স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকে স্বাধীন সময়ের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলছে সোলসের পথচলা। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে সঙ্গীতজগতে এখনো শক্তিশালী স্থান দখল করে আছে ব্যান্ডটি। ভিন্নধর্মী কথা ও সুরে সব সময় শ্রোতাদের নতুন কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে দলটি। এখন সেভাবে অ্যালবাম বের করা না হলেও নিয়মিত ব্যান্ডটিকে চোখে পড়ে টিভি, রেডিও ও বিভিন্ন শো'তে।

সোলসের শুরুর পথচলাটা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। বাংলা গান তখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, লোকগান আর আধুনিক পপগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলা গানের ব্যান্ডের ধারণাটাও কিছুটা নতুন সবার মনে। তার ওপর বিদেশি ঢঙে স্বদেশি গান। তাই অনেকেই যেন ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না এমন এক গানের দলের আবির্ভাব।

সে সময় ব্যান্ডগুলোর বেশিরভাগ পারফর্মেন্স ছিল বড় বড় ক্লাব এবং হোটেলে। তাই মূলত ইংরেজি গানের কাভার করাই ব্যান্ডগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল। সে কারণে তখন ব্যান্ডগুলোর নামও ইংরেজি নামে রাখা হতো। সোলসের সদস্যরা একটা সময়ে নিজেরাই গান বাঁধার সিদ্ধান্ত নেন। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে একটি ফোক ঘরানার গান কম্পোজ করে ফেললেন নকীব খান। তাতেই যেন অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে ব্যান্ডের সদস্যরা। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ পপ কম্পিটিশানে নাম লেখায় সোলস এবং শ্রেষ্ঠ ব্যান্ড নির্বাচিত হয়। সেই থেকেই শুরু হয় সোলসের জয়রথ।

সেই যে শুরু। দেখতে দেখতে পথচলার সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ ৫০ বছরে পূর্ণ করল ব্যান্ড দলটি। এই লম্বা সময়ে দলটিতে অনেকে যুক্ত হয়েছেন, অনেকে বেরিয়ে গেছেন। তবে থেমে থাকেনি সোলস। চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা এই ব্যান্ডটি প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে অটুট রেখেছে তাদের জনপ্রিয়তা। ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর এক ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে দলটি। সেখানে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নতুন লোগো উন্মোচন করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে একইসঙ্গে আগামী দুই বছরের পরিকল্পনা জানানো হবে ব্যান্ডের পক্ষ থেকে। ২০২৪ সালের শেষে একটি গ্র্যান্ড কনসার্ট আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সোলসের ৫০ বছর পূর্তির এ আয়োজন। সোলসের মূল ভোকাল পার্থ বড়ুয়া জানান, ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫০টি গান প্রকাশ করবে সোলস। এর মধ্যে ২০টি নতুন গান ও ৩০টি পুরনো গান নতুন করে প্রকাশ করা হবে। জুলাই মাসে ইংল্যান্ডে ও সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের কনসার্ট রয়েছে। এ ছাড়া দেশ-বিদেশে কয়েকটি কনসার্টের পরিকল্পনা আছে।

পার্থ বড়ুয়া বলেন, 'সঙ্গীতপ্রেমী মানুষের ভালোবাসায় ৫০ বছর ধরে বেঁচে আছে। মানুষের ভালোবাসার টানে রয়ে গেছি।'

সোলসের গানে বাংলাদেশের আত্মার স্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাই ৫০ বছরেও ফুরায়নি তাদের গানের আবেদন। এখনো তরুণদের মুখর আড্ডায়, পিকনিকের আনন্দে কিংবা আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে উলস্নাসের সঙ্গে নেচে নেচে নতুন প্রজন্মের গানপ্রেমীরা গেয়ে ওঠেন 'মন শুধু মন ছুঁয়েছে', 'তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে' অথবা 'এই মুখরিত জীবনের চলার পথে'। এগুলো জনপ্রিয় এই ব্যান্ডেরই গান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় সমবয়সি এই দল। হয়তো আরও ৫০ বছর পর সেদিনের কোনো এক তরুণের কণ্ঠেও উচ্চারিত হবে 'কেন এই নিঃসঙ্গতা'। এভাবেই বেঁচে থাক সোলস যুগের পর যুগ।

সোলসের বর্তমান লাইনআপ- নাসিম আলী খান (ভোকাল), পার্থ বড়ুয়া (ভোকাল ও লিড গিটার), আহসানুর রহমান আশিক (ড্রামস), মীর শাহরিয়ার মাসুম (কিবোর্ড) ও মারুফ হাসান রিয়েল (বেজ গিটার)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে