শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চলে গেলেন রুপালি পর্দার রঙিন নবাব প্রবীর মিত্র

প্রবীর মিত্র তার বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবনে নায়ক হিসেবে হাতেগোনা কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় প্রথম 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' নির্মিত হয়। সেটি ছিল সাদাকালো ছবি। সেই ছবিতে আনোয়ার হোসেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করেন। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে রঙিন 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' নির্মিত হয় আর এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পান প্রবীর মিত্র। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য দেশজুড়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন।
বিনোদন রিপোর্ট
  ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
চলে গেলেন রুপালি পর্দার রঙিন নবাব প্রবীর মিত্র
চলে গেলেন রুপালি পর্দার রঙিন নবাব প্রবীর মিত্র

চলচ্চিত্রের মানুষের শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন রুপালি পর্দার নবাবখ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা প্রবীর মিত্র। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার রাত ১০টা ১০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্না লিলস্নাহি.... রাজিউন)। মৃতুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি এক মেয়ে ও দুই ছেলেসহ অসংখ্য স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। অভিনেতার মৃতু্যর খবরটি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর। এর আগে শনিবার অভিনেতার বড় ছেলে মিঠুন মিত্র জানান, ১০-১২ দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তার বাবা। বয়সের সঙ্গে কিছু শারীরিক জটিলতায় গত ২২ ডিসেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। শরীরে অক্সিজেন পাচ্ছিল না। এরপর আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে কেবিনে দেওয়া হয়েছিল। তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। খারাপ অবস্থার দিকে। বস্নাড লস হচ্ছে, পস্নাটিলেটও কমে যাচ্ছে।

তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। প্রবীর মিত্র ১৯৪১ সালে চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জের শাক্তায়। তবে ঢাকাতেই তার শৈশব জীবন কেটেছে। ঢাকার কোতোয়ালি থানার হরিপ্রসন্ন মিত্র রাস্তাটি প্রবীর মিত্রের দাদার নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। তিনি বিএসসি পাস করার পরে লেখাপড়ার যবনিকা টানেন।

1

অনেকে ঢাকাই সিনেমার 'রঙিন নবাব' বলে ডাকেন প্রবীর মিত্রকে। ১৯৬৮ সাল থেকে প্রবীর মিত্রের চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয়ে ছিল। স্কুলে পড়া অবস্থায় জীবনে প্রথমবারের মতো নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এটি ছিল রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর'। এতে তিনি চরিত্র ছিল প্রহরী চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিলেন। এরপর পুরনো ঢাকার লালকুঠিতে শুরু হয় তার নাট্যচর্চা। পরিচালক এইচ আকবরের হাত ধরে 'জলছবি' চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। ছবির গল্প ও সংলাপ লিখেছিলেন আরেক শক্তিমান অভিনেতা তারই স্কুল জীবনের বন্ধু এ টি এম শামসুজ্জামান।

প্রবীর মিত্র তার বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবনে নায়ক হিসেবে হাতেগোনা কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় প্রথম 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' নির্মিত হয়। সেটি ছিল সাদাকালো ছবি। সেই ছবিতে আনোয়ার হোসেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করেন। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে রঙিন 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' নির্মিত হয় আর এই ছবিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পান প্রবীর মিত্র। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য দেশজুড়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন।

১৯৭০ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে তার অভিনীত উলেস্নখযোগ্য ছবির তালিকায় রয়েছে 'জীবন তৃষ্ণা', 'জলছবি', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'সেয়ানা', 'জালিয়াত', 'রক্তের ডাক', 'ফরিয়াদ', 'রক্ত শপথ', 'চরিত্রহীন', 'জয়পরাজয়', 'অঙ্গার', 'মিন্টু আমার নাম', 'ফকির মজনু শাহ', 'মধুমিতা', 'অশান্ত ঢেউ', 'অলঙ্কার', 'অনুরাগ', 'প্রতিজ্ঞা', 'তরুলতা', 'গায়ের ছেলে', 'পুত্রবধূ' প্রভৃতি।

১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রবীর মিত্র অভিনীত উলেস্নখযোগ্য ছবির তালিকায় রয়েছে 'নৌ চোর', 'সুখে থাকো', 'ঝুমকা', 'সোনারতরী', 'সুখের সংসার', 'প্রতিহিংসা', 'আরশীনগর', 'মানসম্মান', 'চেনামুখ', 'অপমান', 'চ্যালেঞ্জ', 'ফেরারী বসন্ত', 'আঁখি মিলন', 'রসের বাইদানী', 'নয়নের আলো', 'মন পাগলা', 'জিপসি সর্দার', 'দহন', 'মায়ের দাবি', 'ঘর ভাঙা ঘর', 'রানী কেন ডাকাত', 'বেদেনীর প্রেম' প্রভৃতি।

প্রেমিকাকে বিয়ে করতেই মুসলমান হয়েছিলেন প্রবীর মিত্র। নামের কারণে প্রবীর মিত্র হিন্দু না মুসলাম- এ নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে অনেকের মনে। সে বিষয়ে খোলাসা করেছেন মিশা সওদাগর। তিনি জানিয়েছেন, প্রবীর মিত্র ভাই মুসলামনই ছিলেন। ধর্মমতে তার জানাজা হবে এবং দাফন হবে।

এক সাক্ষাৎকারে প্রবীর মিত্র নিজেও ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। সে সময়ের ভিডিওতে প্রবীর মিত্রকে বলতে শোনা যায়, 'আমি তো কনভার্ট হয়েই ওর মাকে (স্ত্রী) বিয়ে করেছিলাম। তখন মুসলমান হয়েছিলাম। তখন প্রয়োজন হয়েছিল মুসলমান হওয়া, এখনো সে ধর্মেই আছি। সেই সাক্ষাৎকারে প্রবীর মিত্র জানিয়েছেন তার কষ্টের কথা। বলেছেন, অভিনয় করতে না পারলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি অভিনয় করতে পারছি না, এটাই আমার বড় কষ্ট। অভিনয়টা আমাকে খুব টানে। অপেক্ষায় আছি, সুস্থ হয়ে আবার অভিনয়ে ফেরার। কিন্তু এ অভিনেতার আরও অভিনয়ে ফেরা হলো না।

ভিডিওতে সহকর্মীদের কথাও বলেছেছিলেন অভিনেতা। জানিয়েছেন, অনেকেই তার খোঁজখবর নেন। সবাই তার জন্য দোয়া করেন। তিনিও সবার জন্য দোয়া করেন, সবাই যেন ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে ধর্ম নিয়ে জানতে চাইলে প্রবীর মিত্র জানান, বিয়ের সময় মুসলমান হিসেবে কনভার্ট হয়েই বিয়ে করেছিলেন। সেই সূত্র ধরেই মাঝে খবর ছড়ায় প্রবীর মিত্র মুসলমান হয়েছেন। তবে ধর্ম নিয়ে প্রবীর মিত্রের ভাবনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধর্ম নিয়ে আমার কোনো বাড়াবাড়ি নেই। সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই। মানুষ সবার উপরে।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮২ সালে মহিউদ্দিন পরিচালিত 'বড় ভালো লোক ছিল' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান প্রবীর মিত্র। আর ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। ব্যক্তি জীবনে তার তিন ছেলে, এক মেয়ে। স্ত্রী অজন্তা মিত্রকে ২০০০ সালে হারানোর পর ২০১২ সালে তার ছোট ছেলে আকাশও পরপারে পাড়ি জমান।

প্রবীর মিত্রের মৃতু্যতে দেশের বিনোদন জগতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সহকর্মী শিল্পী ও পরিচালকরা তার মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতির কথা উলেস্নখ করে তারা বলেছেন, 'প্রবীর মিত্র ছিলেন এক বহুমুখী প্রতিভা ব্যক্তি। তার চলে যাওয়া আমাদের জন্য এক বিরাট শূন্যতা।' অভিনেতার মৃতু্যতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি এবং বিভিন্ন সংগঠন শোকবার্তা জানিয়েছে। প্রবীর মিত্রের মৃতু্যতে শোক ও শান্তি কামনা করে সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছেন সুপারস্টার শাকিব খান। বরেণ্য এই অভিনেতার মৃতু্যতে গভীর শোক জানিয়ে শনিবার রাতে স্ট্যাটাসে এই নায়ক লিখেন, 'যেখানে থাকুন, শান্তিতে থাকুন...।

মিশা সওদাগর লিখেছেন, 'প্রবীর মিত্র দাদা আর নেই। কিছুক্ষণ আগে উনি ইন্তেকাল করেছেন। স্রষ্টা তাকে ক্ষমা করুক।' জায়েদ খান লিখেছেন, 'প্রবীর মিত্র দাদা আর নেই। কিছুক্ষণ আগে উনি ইন্তেকাল করেছেন। স্রষ্টা তাকে ক্ষমা করুক। হে আলস্নাহ আমাদের শোক সইবার ক্ষমতা দাও।'

দিনাত জাহান মুন্নী শোক জানিয়ে লেখেন, 'চলচিত্রে আমাদের আবেগের জায়গা জুড়ে ছিলেন প্রবীর মিত্র। অভিনয়ের বাইরে তিনি ছিলেন একান্ত নিভৃতচারী। তিনি চলচিত্রে সবসময় সৎ ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করতেন। আজ তিনিও চলে গেলেন জীবন থেকে পরপারে। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।'

ইমন সাহা লিখেছেন, 'কী হচ্ছে কে জানে? ঈশ্বর কী চান তা একমাত্র তিনিই জানেন। গত কয়েকদিন ধরে শুধু আপন মানুষ হারানোর বার্তাই দিয়ে যাচ্ছি। প্রবীর মিত্র কাকু আমাদের পরিবারের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন। আমাদের চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ছবিতেই তার উপস্থিতি ছিল। তার মতো ভাল মানুষ এ জগতে বিরল। জীবনে কারো সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছেন বলে আমার চোখে পড়েনি। হাসি মুখ ছাড়া আপনাকে কোনোদিন দেখিনি। দীর্ঘ দিনের অসুস্‌স্থতা জানার পরও আপনার চলে যাওয়া মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।'

সাজ্জাদ হোসেন দুদুল লিখেছেন, 'প্রিয় প্রবীর চাচা, আপনি আমাদের মাঝে নেই শুনতে ভীষণ কষ্ট হলো। কিন্তু ঈশ্বরের বিধান আমরা মেনে নিতে বাধ্য। আমার বাবা আমজাদ হোসেনের প্রায় সব ছবিতে আপনি অভিনয় করেছেন। আপনার জন্য বাবা আলাদাভাবে যত্ন নিয়ে চরিত্র তৈরি করতেন। আপনি কতো বড় মাপের শিল্পী তা বাংলাদেশের সকলে জানে। আপনার অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমার পরিচালনাতেও কাজ করেছেন। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। আপনার ভালোবাসায় বন্দী আমরা। জীবনের শেষ বাস্তবতা কষ্ট ছাড়া আর কিছুনা। জীবন একটা স্মৃতি মাত্র। ওপারে ভালো থাকবেন চাচা।'

চিত্রনায়িকা মুনমুন শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, ইন্না লিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। প্রবীর মিত্র দাদাও চলে গেলেন না ফেরার দেশে। পরপর দুজন গুনী শিল্পীকে আমরা হারালাম। আলস্নাহ তায়ালা প্রবীর মিত্র দাদাকে জান্নাতবাসী করুন, আমিন।

অভিনেতা প্রবীর মিত্রর প্রথম জানাজা সোমবার বাদ জোহর এফডিসির জহির রায়হান ভিআইপি প্রজেকশনের সামনে সম্পন্ন হয়। এ সময় প্রবীর মিত্রকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে এফডিসিতে উপস্থিত হয়েছিলেন তার সহকর্মীসহ নবীন-প্রবীণ চলচ্চিত্রকর্মীরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে