শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
সক্রিয় সিন্ডিকেট

রমজানের আগেই অস্থির মসুর ডালের বাজার

এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৯ টাকা, মণপ্রতি ৪০০ টাকা পণ্যের সরবরাহ সংকটও নেই তারপরও বাড়ছে দাম
আহমেদ তোফায়েল
  ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:০১

বাজারে কয়েক মাস ধরেই চাল, চিনি থেকে শুরু করে বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। রমজান সামনে রেখে বাজারে আরও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই প্রতিবছর রমজানে চাহিদা থাকে এমন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। কৌশলী ব্যবসায়ীরা এবারও তাই দুই মাস আগেই রমজানের অতি প্রয়োজনীয় পণ্য মসুরের ডালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। মিরপুর ১ নাম্বারের নোয়াখালী জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. বাবলু মিয়া জানান, দেশি মসুর ডাল এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৮-৯ টাকা। এক সপ্তাহ আগে তিনি পাইকারি দরে কিনেছেন ৯৫ থেকে ৯৬ টাকায়। সে ডাল তাদের কিনতে হচ্ছে ১০৬ টাকায়। আর তিনি বিক্রি করছেন ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়। অর্থাৎ কেজি বিক্রি করছেন ১১৫ টাকা আর ৫ কেজি বিক্রি করছেন ৫৭৫ টাকায়। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগেও মণপ্রতি দেশি ডালের দাম ছিল ৩ হাজার ৮৪০ টাকা এখন হয়েছে ৪ হাজার ২৪০ টাকা। অর্থাৎ মণপ্রতি মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪০০ টাকা। শুধু দেশি মসুরের ডাল নয়, এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের আমদানি করা ডালের দাম বেড়েছে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসেবে এক মাসের মধ্যে তুরস্ক ও কানাডা থেকে আমদানি করা বড় দানার মসুর ডালের দাম বেড়েছে ১৩ দশমকি ১৪ শতাংশ। এক মাস আগে এ জাতীয় মসুরের ডালের দাম ছিল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। শনিবার এর বাজার দর ছিল ৯৮ থেকে ১০ টাকা। ওই দেশ থেকে মাঝারি মানের দানার ডালের দাম বেড়েছে ৯ দশমকি ১৪ শতাংশ। নেপাল থেকে আমদানি করা ১২০-১৩০ টাকার ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৪০ টাকায়। এ হিসেবে বেড়েছে ৬ শতাংশ। আর মান ভেদে এক মাসের ব্যবধানে ছোলার দাম বেড়েছে ১৪ দশমকি ৮১ শতাংশ। ৭০ টাকার ছোলার ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ডাল ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, বাজারে ডাল জাতীয় প্রতিটি পণ্যের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে। এরপরও কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক কারসাজি করে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ডাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স পায়েল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আশুতোষ মহাজন বলেন, 'বাজারে চাহিদার চেয়ে ছোলার সরবরাহ সংকট রয়েছে। এ ছাড়া মটর ও মসুরের আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং দর বেড়েছে। ফলে দেশীয় বাজারে ডাল জাতীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।' তবে পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী মেসার্স হক ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে শুধু মসুরের বুকিং দর বেড়েছে। ডাল জাতীয় অন্য পণ্যের দাম স্থির রয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে বাজারে যেসব মসুর বিক্রি হচ্ছে তা কমপক্ষে এক থেকে দুই মাস আগের কেনা। এক সপ্তাহ ধরে যেসব মসুরের বুকিং দর বেড়েছে তা বাজারে পৌঁছাবে আরও এক-দেড়মাস পর। কোনো পণ্যের সরবরাহ সংকটও নেই বাজারে। শুধু আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে পণ্যগুলোর দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করে তুলেছে।' চট্টগ্রাম ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস এম মহিউদ্দিন বলেন, 'বাজারে ডালজাতীয় পণ্যের চাহিদা, আমদানি ও সরবরাহ সবই ঠিক রয়েছে। বাজারের কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি পুরো বাজার। ফলে আমদানিকারকরা যখন ইচ্ছা কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার কখনো চাহিদার চেয়ে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে পণ্যের দাম কমে যায়।' বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বাজার মনিটরিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। সংশ্লিষ্টরা জানান, রমজানে ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, মটরের বাড়তি চাহিদা থাকে। এবার ছোলা প্রচুর মজুত ও আমদানি হচ্ছে। ফলে ছোলার দাম বাড়বে না। তবে মসুর ও মটর ডালের দাম বাড়তে পারে। এসব পণ্য আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। এরই মধ্যে কিছু পণ্য দেশে পৌঁছেছে। আর পাইপলাইনে রয়েছে প্রচুর পণ্য। ডালজাতীয় পণ্য আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, মসুর ও মটর ডালের আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। তাই এ পণ্যের দাম সামনে বাড়তে পারে। তবে খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। পাইকারি বাজারের চেয়ে খুচরা বাজারে দ্বিগুণ বেশি দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। টিসিবি সূত্র জানায়, রমজান মাসে যাতে ভোগ্যপণ্যের বাজার বাড়তে না পারে সে লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ১৭ হাজার টন মসুর ডাল কেনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ডিলারদের মাধ্যমে খোলাবাজারে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ডালের চাহিদার অর্ধেকের বেশি আমদানি করতে হয়। অথচ দেশে ডালের চাহিদা প্রায় ৫ লাখ টন। মসুর ডালের মাসে চাহিদা হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টন। আর রোজার মাসে এই চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার টনে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ-উপদেষ্টা ডক্টর এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এরপর নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে নিম্নআয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। তিনি বলেন, 'বাজার নজরদারির জন্য সব সময় বলে আসছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। কী কারণে দাম বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত। এক্ষেত্রে কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হলে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।' জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হচ্ছে। রমজানকে টার্গেট করে এখন থেকেই মনিটরিং জোরদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। দরকার হলে প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রমজান সামনে রেখে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে আগে থেকেই কাজ করা হচ্ছে। রমজানে যাতে মানুষের কষ্ট না হয়, সেজন্য সাশ্রয়ী দামে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের একাধিক সংস্থা বাজার তদারকি করবে। পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা রমজানে পণ্যের দাম খুব কম বাড়ায়। রমজান আসার আগেই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে মনিটরিংও আগেভাগেই করতে হবে। কঠোর তদারকির মাধ্যমে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি জানান, অযৌক্তিক মুনাফা করতে ব্যবসায়ীরা সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়ায়। এই প্রবণতা কারও জন্যই শুভ নয়। ভোক্তাদের উদ্দেশে গোলাম রহমান বলেন, রমজান ঘিরে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। ১৫ দিনের পণ্য যাতে একদিনে না কেনেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। আর ব্যবসায়ীরাও সুযোগ বুঝে পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে