শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সন্দেহভাজন ৩৪ কোম্পানি এনবিআরের তালিকায়

বন্ড সুবিধার অপব্যবহার
ম আহমেদ তোফায়েল
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:১৮

বন্ড সুবিধায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমদানি-রপ্তানির কারণে সরকার হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব। এ অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা যাবে। এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে এমন রপ্তানিমুখী ৩৪ সন্দেভাজন কোম্পানির তালিকা তৈরি করেছে এনবিআর'র কাস্টমস বিভাগ। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) বাইরে পরিচালিত ২৩টি রপ্তানিমুখী কোম্পানি এবং সাধারণ বন্ড সার্কেলের অধীনে ১১টি কোম্পানির নাম সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে 'ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প' হিসেবে চিহ্নিত করে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কাস্টমস কমিশনার কাজী মুস্তাফিজুর রহমান সদস্যের (কাস্টমস বন্ড, রপ্তানি ও আইটি) কাছে ৩ ফেব্রম্নয়ারি প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাধারণ বন্ড বা শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় আমদানি করা ঝুঁকিপূর্ণ আইটেমগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো- এলডিপিই, এলএলডিপিই, বিওপিই, এইচডিপিই, আর্ট কার্ড, পলি ব্যাগ, কার্টুন, ডুপেস্নক্স বোর্ড, ভার্জিন গ্রেড লাইনার পেপার, পিভিসি ফিল্ম, শিট, গাবারস সল্ট। কাস্টম বিভাগের প্রতিবেদনে কিছু অনিয়ম ওঠে এসেছে এবং তারা দেখেছে যে এই পণ্যগুলো প্রায়ই খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, অ্যাসোসিয়েশন শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এবং সরকারের উচিত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। তবে তিনি অভিযোগ করেন, সংশ্লিষ্ট হ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহায়তা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান আইন লঙ্ঘন করতে পারে না। বন্ডেড গুদাম ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে উভয় পক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যোগ করেন তিনি। সম্প্রতি এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর প্রধান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বন্ড সুবিধা অপব্যবহারের প্রবণতার কথা উলেস্নখ করে বলেন, বন্ড সুবিধা অপব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। এটা সহজে দূর করা যাবে না। এটা দূর করতে তাদের বন্ড অটোমেশন আপডেট করতে হবে। যখন আপডেট হবে, তখন অপব্যবহার দূর হবে। যখন তারা (এনবিআর) হিসাব রাখতে পারবেন, তখন অপব্যবহার কমানো সম্ভব হবে। বন্ড সুবিধা অপব্যবহার যতটুকু রাজস্ব খাতে প্রভাব ফেলে তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতে। কাস্টমস বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাধারণ বন্ড সার্কেলের অধীনে সুবিধার সম্ভাব্য অপব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- বিএসপি পস্নাস্টিক (বিডি) প্রাইভেট লিমিটেড, পারমেস সাউথ ইস্ট এশিয়া লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল ট্রিমিংস অ্যান্ড লেবেলস (বিডি) প্রাইভেট লিমিটেড, জাবের এবং জুবায়ের এক্সেসরিজ লিমিটেড, বাংলাদেশ মাস্টার প্যাক লিমিটেড, ওয়েব কোটস লিমিটেড, রাঙ্কা ডেনিম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, মানতাকা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, আইডিয়াল পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেড, টোরি এন্টারপ্রাইজ (প্রাইভেট) লিমিটেড, নাহিদ পস্নাস্টিক (বিডি) লিমিটেড, আলিজা ফ্যাশন লিমিটেড, অ্যাস্ট্রো স্টিচ আর্ট লিমিটেড, আজিম অ্যান্ড সন (প্রাইভেট) লিমিটেড, বটমস গ্যালারি (প্রাইভেট) লিমিটেড, আলস্নুরিং ফ্যাশনস লিমিটেড, বসুনিয়া টেক্সটাইলস লিমিটেড, হাসান তানভীর ফ্যাশন ওয়্যারস লিমিটেড, রুপা নিটওয়্যার (পিভিটি) লিমিটেড এবং এসআরকেএইচ ডিজাইন লিমিটেড। বিশেষ বন্ড সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- লিউ ফ্যাশন লিমিটেড, বস্নু পস্নানেট ফ্যাশন ওয়্যার লিমিটেড, বস্নু পস্নানেট নিট ওয়্যার লিমিটেড, রাতুল অ্যাপারেল্‌স লিমিটেড, সামিটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মা স্টিচ, অ্যাট্রাকশন গার্মেন্টস লিমিটেড, করোনা ফ্যাশন লিমিটেড, পোশ গার্মেন্টস লিমিটেড, ইম্পেরিয়াল সোয়েটার (বিডি) লিমিটেড, গ্রিন ওয়ার্ল্ড ফ্যাশনস লিমিটেড, এএম ফ্যাশন, এটিএস অ্যাপারেলস লিমিটেড, আলিফ ক্যাজুয়াল ওয়্যার লিমিটেড। শিল্পগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে কাস্টমস বন্ড অফিস করফাঁকি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য তুলে এনেছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে সরকার শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক-করমুক্তভাবে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ দিয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান এ সুবিধার অপব্যবহার করছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্য রাতের আঁধারে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি স্থানীয় শিল্প দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এনবিআর সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনকালে বা অডিটে এক কোটি টাকার বেশি শুল্ক ফাঁকি ধরা পড়লে বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ পাচার অনুসন্ধান করা হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা শুল্ক গোয়েন্দা এ অনুসন্ধান করবে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানের মালিক বা শেয়ার হোল্ডারদের ব্যক্তিগত আয়কর ফাঁকি খতিয়ে দেখবে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। এ চক্রের কারণে পুরো রপ্তানি খাত তথা দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারা আরও জানান, রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে বন্ড সুবিধায় বিনা শুল্কে আমদানি করা কাগজ, বোর্ড এবং সুতা, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য বেআইনিভাবে খোলাবাজারে বিক্রির কারণে দেশি শিল্প খাত হুমকির মুখে পড়ছে। দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের তৈরি মানসম্মত পণ্যও বিনা শুল্কের কম দামি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারছে না। এতে দেশের রপ্তানিমুখী স্পিনিং ও উইভিং মিলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে দেশের অনেক বস্ত্রকল এখন শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন, মজুরি ও অন্য ইউটিলিটি ব্যয় মেটাতে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে সুতা ও কাপড় বিক্রি করছে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান কার্যত বন্ধ থাকলেও তাদের বন্ড লাইসেন্স বিভিন্ন পন্থায় কার্যকর রেখে সুবিধা নিচ্ছে। বন্ডেড ওয়্যার হাউস লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চিহ্নিত এবং তাদের মধ্যে কতটি চালু আছে, তা নির্ধারণ করে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ড লাইসেন্স বাতিল করার উদ্যোগ নিবে এনবিআর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, কিছু ব্যবসায়ী বন্ডের সুবিধা নিয়ে এক পণ্যের নামে অন্য পণ্য আমদানি করছেন। এতে দেশি বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তাই যারা এভাবে বন্ডের অপব্যবহার করছে তাদের দমনে কঠোর হচ্ছে এনবিআর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে