ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ফুটপাত ও সড়কে ভ্যান নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসা হকারদের কাছ থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর পুরোটাই ঢুকছে চাঁদাবাজ ও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকদের পকেটে। ফুটপাত ও সড়কের এসব দখলদার উচ্ছেদে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হলেও তা পরিকল্পিত না হওয়ায় মূল লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, এ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের খেলা চললেও কৌশলী কর্মপরিকল্পনা না থাকার কারণে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এছাড়া ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে হকার বসানো গডফাদারদের সঙ্গে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ চক্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব যায়যায়দিনকে বলেন, অবৈধ কর্মকান্ডে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা প্রমাণ করে তারা কোনো না কোনোভাবে এসবের সঙ্গে জড়িত। অবৈধ দখলদারদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারছে না বলেই ফুটপাতের একটি বড় অংশ হকারদের দখলে চলে গেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে। তবে হকারদের ফুটপাত দখলের অবৈধ কার্যক্রম শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে তারা নীরব থাকছে। সরকারের যেসব সংস্থা বা কার্যালয় নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনলেই এসব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন এ পরিকল্পনাবিদ।
তবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, মূলত এই হকার বসানো ও উচ্ছেদ নিয়ে চলে রাজনীতি। হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেওয়া হয়। এই চাঁদার ভাগ যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মীর কাছে। আর এর পরিমাণও নেহাত কম নয়। তাই মাঝেমধ্যে পরিস্থিতির ফেরে তারা হকার উচ্ছেদের কাজে অংশ নিলেও বস্তুত আবার তাদের পুনর্বাসনে সহায়ক শক্তি হিসেবেই থাকেন। তাই সদিচ্ছা থাকলেও দখলদার উচ্ছেদে ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন। যদিও প্রশাসনের মুষ্ঠিমেয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার ফুটপাত বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথাও তারা স্বীকার করেন।
রাজধানীর বিপুল সংখ্যক হকার ও তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের
\হনেতারাই মূলত তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন নিজেদের মিছিল-সমাবেশে শো-ডাউন দেওয়ার স্বার্থে। কেননা দলীয় কর্মীরা অনেকেই এখন দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে চান না। তাই অনেক নেতাকেই এখন মিছিল-সমাবেশে বেশি লোক দেখানোর জন্য হকারদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ওপর হকারদের কাছ থেকে আদায়কৃত চাঁদার পরিমাণও কম নয়। তাই হকার এখন অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ব্যবহারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
'ঢাকা মহানগরে যানজট-শাসন-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে' নামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই সিটি করপোরেশন মিলে ঢাকার ফুটপাতের দৈর্ঘ্য ৪৩০ কিলোমিটার। এই ফুটপাত দখল করে অবৈধ পথে হকারদের ব্যবসা চলে। প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকার রাস্তায় আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করে। ফুটপাতে বসতে একজন হকারকে এলাকাভেদে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। লাইনম্যানদের মাধ্যমে এই টাকার ভাগ চলে যায় রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলে।
অংশীজন ও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে হকারদের কাছ থেকে তোলা চাঁদার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এই অঙ্ক ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট বাজেটের কাছাকাছি।
হকার নেতারা জানান, দুই সিটি করপোরেশন মিলে হকারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। তাদের কাছ থেকে দিনে ২০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এটার টাকা রাজনৈতিক নেতা কিংবা পুলিশকে না দিয়ে সরকারকে রেভিনিউ হিসেবে দেওয়া হলে হকার পুনর্বাসনের তা কাজে লাগত। হকারদের পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদের মাধ্যমে ফুটপাত দখলমুক্ত করা অনেকটাই অসম্ভব বলে মনে করেন তারা।
এদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদরাও অনেকে হকারদের দেওয়া টাকাকে আনুষ্ঠানিক রাজস্বে রূপ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, হকারদের থেকে পাওয়া বিশাল অঙ্কের টাকা সিটি করপোরেশনের রাজস্ব খাতে যোগ করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে হকারদের পরিচয়পত্র ও লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে তাদের একটি ব্যবস্থার আওতায় আনা উচিত। আর যে এলাকার হকারদের থেকে বেশি রাজস্ব আসবে, সেই এলাকার পুলিশদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা এবং লাইনম্যানদের ব্যবস্থাপনার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব দেওয়া হলে অবৈধ আয়ের বিষয়টিও কমে যাবে।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, হকাররা অর্থনীতির একটা বড় অংশ। কিন্তু হকারদের সঠিক সংখ্যাই কোনো কর্তৃপক্ষ জানে না। এদের নিয়ে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের সার্বিক পরিকল্পনা দরকার।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর মোট ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতের ৬৬ দশমিক ২৫ শতাংশ এখন হকারদের দখলে। এ হিসেবে ১০৮ দশমিক ৬০ কিলোমিটার ফুটপাতে হকাররা দোকানপাট বসিয়েছেন। এছাড়া ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের ৫৭২ দশমিক ৪২ কিলোমিটারেও হকার্স মার্কেট রয়েছে।
নগরীর সিংহভাগ ফুটপাত বেদখলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পুলিশকে দুষলেও তারা এ ব্যাপারে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিকে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে অসাধু কিছু পুলিশ সদস্য উৎকোচ নিলেও রাজনৈতিক নেতারাই মূলত তাদের সেখানে দোকান বসানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হকাররা ফুটপাতে দোকান বসাচ্ছেন।
অন্যদিকে হকার নেতারা বলছেন, তাদের ঘাড়ে ভর করে পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা ফুটপাত দখল বাণিজ্য চালাচ্ছেন। তারা হকারদের কাছ থেকে দৈনিক মোটা অঙ্কের চাঁদা তুলছে। যার একটি অংশ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ চক্রের হাতে পৌঁছাচ্ছে। হকাররা যতটা জায়গা দখল করে দোকান বসাচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্থায়ী দোকান মালিকদের দখলে রয়েছে।
বাংলাদেশ ছিন্ন মূল হকার্স সমিতির জরিপের তথ্যমতে, নগরীর ফুটপাতের মাত্র ১৩ ভাগ হকারদের দখলে। রাস্তাসংলগ্ন স্থায়ী দোকানিরা ১৫ ভাগ ফুটপাত দখল করে তাদের বিভিন্ন মালামাল রাখছে। অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট মালিক ফুটপাত গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদের ক্রেতাদের গাড়ি পার্কিংয়ের স্থায়ী ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া ফুটপাতের ৫ শতাংশ দখল করে পাবলিক টয়লেট ও অন্যান্য যাত্রীছাউনি এবং ১ শতাংশ দখল করে রাজনৈতিক দলের অফিস গড়ে উঠেছে। পার্কিংবিহীন বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলো ৬ শতাংশ ফুটপাত দখল করে বিভিন্ন যানবাহন রাখছে। এছাড়া মসজিদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ফুটপাত দখল করেও স্থায়ী দোকানপাট গড়ে তুলেছে।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের এডিসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, করোনা মহামারিতে নিম্নবিত্ত শ্রেণিদের একটি বড় অংশ কাজকর্ম হারিয়ে অতিদরিদ্রের কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ওপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিক মন্দায় খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি দেখা দেওয়ায় মধ্যবিত্তদের অনেককে ফুটপাতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তারা ভ্যানে বিভিন্ন পণ্য সাজিয়ে রাস্তার পাশে বিক্রি করছে। এতে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। যানবাহনের গতি কমছে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ট্রাফিক পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কৌশলী কর্মপরিকল্পনা জরুরি বলে মনে করেন এই দায়িত্বশীল ট্রাফিক কর্মকর্তা।
এদিকে নগরবাসীর অভিযোগ, ফুটপাত দখল মুক্ত করতে হাইকোর্টের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও সিটি করপোরেশন ও পুলিশ কেউই এর তোয়াক্কা করছে না। রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনের আগে এসব দখল মুক্ত করে হকারদের পুনর্বাসন করার অঙ্গীকার করলেও নির্বাচনের পর তারা নিজেরাই ফুটপাত দখল বাণিজ্যে নামছেন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, যানজটের কারণে শহর চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। এজন্য প্রশাসনের ব্যর্থতা দায়ী। তারা সঠিকভাবে কাজ করে না। উল্টো এ ফুটপাত ইজারা ও টোল আদায় করে বাণিজ্য শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার আইনগতভাবে সেটা নিশ্চিত করবে। কিন্তু মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে তো ব্যবসার সুযোগ দিতে পারে না।