বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন

৮০% শিশু বাংলা ইংরেজি ও গণিতে পিছিয়ে
যাযাদি ডেস্ক
  ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০
প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন

দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় শতভাগ শিশুর উপস্থিতির সাফল্য দৃশ্যমান হলেও শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েই গেছে। শিক্ষার মান খারাপ হওয়ায় অনেকে পড়া, লেখা ও গণিতের মৌলিক সমস্যার সমাধান করার দক্ষতা অর্জন না করেই প্রাথমিকের স্তর পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রতি বছরই শিক্ষায় ব্যয় বাড়ছে। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও প্রাথমিক শিক্ষায় ২ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়াসহ বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করছে। তবে এসব প্রচেষ্টা মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে কতটুকু ভূমিকা রাখছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা গেলে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ শিশু বাংলা পড়তে পারে না। এর মধ্যে ১০.২৮ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী ও ৮.৭১ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। এছাড়া প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে পিছিয়ে। এ স্তরের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশু বাংলা-ইংরেজি পড়তে পারে না। ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাধারণ যোগ-বিয়োগও করতে পারে না। জরিপ অনুযায়ী, গণিত বিষয়ে ১৩.৬২% শিশু একক অঙ্ক বিশিষ্ট সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে না। শুধু ২৩.৫৪% শিশু দু'টি যোগ সমস্যার সমাধান করতে পারে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের দু'টি বিয়োগ ও দু'টি ভাগ সমস্যার সমাধান করতে পারে না পর্যায়ক্রমে ৭৯.৫৩% এবং ৯৬.৫৪% শিশু। এছাড়া সবচেয়ে করুণ অবস্থার চিত্র ইংরেজিতে। এ বিষয়ে ছেলে শিশুর মধ্যে ১৬.৭৮% এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ১৫.২২% প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের একটি বর্ণও পড়তে পারে না। ২৩.৮৭% শিশু ৫টির মধ্যে কমপক্ষে ৪টি ইংরেজি শব্দ শনাক্ত করতে পারে। আর ৮৪.১৫% ছেলে শিশু এবং ৮২.৮৬% মেয়ে শিশু ৩টি বা তার কম ভুল উচ্চারণসহ একটি কাহিনী সাবলীলভাবে পড়তে পারে না। অভিভাবকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা যাচাইয়ে দেখা যায়, যেসব শিশুর পিতা-মাতার মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ছিল, তারা ভাষার দক্ষতার ক্ষেত্রে ভালো করেছে, তাদের তুলনায় স্বল্প শিক্ষিত পিতা-মাতার শিশুদের ভাষার দক্ষতা সন্তোষজনক ছিল না। যেসব শিশুর পিতা-মাতার মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ছিল, তাদের মধ্যে ৪৫৯ জন শিশু বাংলায় এবং ১৯২ জন শিশু ইংরেজিতে কাহিনী পড়তে পেরেছে। আর যেসব অভিভাবকের প্রাথমিক বা কম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল, তাদের শিশুদের মধ্যে মাত্র ২৩ জন শিশু বাংলায় এবং ৭৮ জন শিশু ইংরেজিতে অক্ষর শনাক্ত করতে পেরেছে। দ্য সাউথ এশিয়ান অ্যাসেসমেন্ট অ্যালায়েন্স কমিউনিকেটিং অ্যান্ড কোলাবোরেটিং ফর চেঞ্জ (ইওএল) প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়েভ ফাউন্ডেশন খুলনা ও রাজশাহী জেলার ৮৮টি গ্রামের ৭১টি বিদ্যালয়ে এবং ১৭৬০টি পরিবারের ১৫৩৩ জন শিশুর ওপর 'সিটিজেন লেড অ্যাসেসমেন্ট' নামে এই জরিপ চালায়। শিক্ষার্থীদের (৫-১৬ বছর বয়সি) অভিগম্যতা পর্যালোচনা ও শিক্ষার গুণগতমান পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে মৌলিক পঠন ও গাণিতিক শিখন যাচাই করার জন্য জরিপটি চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি। মানহীন শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতাও একপ্রকার দায়ী বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, প্রায় সব অভিভাবকই তার বাচ্চাকে ক্লাসের প্রথম/দ্বিতীয় অবস্থানে দেখতে চান। অনেক অভিভাবক আছেন, যারা বেশি বেশি হোমওয়ার্ক দেওয়া শিক্ষক, সারা বছর পরীক্ষা নেয় এমন স্কুল এবং কোচিং সেন্টার ও গৃহশিক্ষকদের পছন্দ করেন। অভিভাবকরা মনে করেন, বেশি বেশি পড়াশোনা করলেই বাচ্চার শিক্ষাজীবন ভালো হবে, ভালো চাকরি হবে। এছাড়া একটি হাস্যকর বিষয় রয়েছে বাংলাদেশের কেজি স্কুলগুলোতে। এখানে চার বছর লাগে ক্লাস ওয়ানে উঠতে। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন পদ্ধতি নেই। ফলে শিক্ষা থেকে এসব অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মধ্যে নেদারল্যান্ডসের শিশুরা সবচেয়ে সুখী। তাদের মাধ্যমিকের আগে কোনো হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় না। লেখাপড়া করতে কোনো চাপই নেই তাদের ওপর। এছাড়া ফিনল্যান্ডে ১৬ বছরের আগে কোনো বাধ্যতামূলক পরীক্ষা নেই। এদের হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় খুব কম। অথচ আমাদের দেশে এতদিন ১৬ বছরের মধ্যেই ৩টি পাবলিক পরীক্ষা ছিল। সেটা এখন কমানো হয়েছে, যা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শুধু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোই নয়, শিক্ষার মানের দিকেও নজর দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে ওয়েভ ফাউন্ডেশন শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতসহ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। এগুলো হলো- অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত, শিক্ষকদের ক্লাস পরিচালনায় নিয়মিতকরণে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, শিক্ষার গুণগতমান অর্জনে শ্রেণির পড়া শ্রেণিতেই সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া, অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা, শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া, সময়োপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও বিতরণ, স্কুল ফিডিং কার্যক্রম প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকাতে চালু এবং শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নে নীতিনির্ধারক, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ অংশীজনের মতামতের আলোকে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। অন্যদিকে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষাবিদ ও মনোচিকিৎসকরা শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের বোঝা কমানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন বহুদিন ধরেই। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। এছাড়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ৪ অনুসারে ২০২৩ সালের মধ্যে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সবার সমান শিক্ষা লাভের সুযোগের যে কথা বলা হয়েছে তা নিশ্চিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে