সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

উৎকণ্ঠায় সাড়ে ১৩ লাখ পরীক্ষার্থী

নেপথ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি
সাখাওয়াত হোসেন
  ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

চট্টগ্রাম, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ড ছাড়া সারা দেশে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ ১৭ আগস্ট। যা চলবে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ নাগাদ। অথচ এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ১৬ থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত পদযাত্রাসহ চার দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। একই সঙ্গে শিগগিরই কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সরকারবিরোধী এ দলটি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ১৮ আগস্ট দোয়া এবং ২৩ আগস্ট সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিলের ঘোষণা দিয়েছে।

এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বরাবরের মতো কর্মসূচি ঘোষণা দেবে কিনা, রাজপথে দুই দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থান থাকে কিনা, সংঘর্ষ বাধবে কিনা, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কতটা মারমুখী হবে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পরীক্ষা কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পথ কতটা নিরাপদ থাকবে- এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে সাড়ে ১৩ লাখ তরুণ পরীক্ষার্থী।

এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের এখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে পূর্ণ মনোসংযোগের সঙ্গে পড়া রিভিশন দেওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন কর্মসূচিতে রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি কী হবে- এ আশঙ্কায় তারা অনেকেই উৎকণ্ঠায় ভুগছে। বিশেষ করে যে পরীক্ষার্থীদের বাসা পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে বেশ কিছুটা দূরে এবং যাদের নিজস্ব পরিবহণ নেই- তারা চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করার কথা অপকটে স্বীকার করেছেন। তারা পরীক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে না দিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় পক্ষের প্রতি জোরালো আহবান জানিয়েছেন। এদিকে এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়টুকুতে কোনো ধরনের কঠোর কর্মসূচি না দেওয়ার জন্য দেশের সুধীমহল সব রাজনৈতিক দলগুলো প্রতি জোরালো আবেদন জানিয়েছে।

দেশের শিক্ষাবিদরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, গত কয়েক মাসে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়নি। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচির নামকরণও ছিল 'শান্তিপূর্ণ'। অথচ দু'দলের এসব কর্মসূচির মাঝেই জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ করতে হয়েছে। এমনকি রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসও ছুড়তে হয়েছে। এতে শুধু আন্দোলনকারীরাই নন,

সাধারণ পথচারীরাও আহত হন। তাই পরীক্ষা চলাকালে যে কোনো কর্মসূচি নিয়ে পরীক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিরোধী জোটের আন্দোলন যাই হোক এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ীই সব পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এ জন্য সরকার ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে। আন্দোলন কর্মসূচিতে যাতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া-আসার পথের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

সাউথ পয়েন্ট মালিবাগ শাখার শিক্ষার্থী ফাইজা ইসলামের বাবা আনিসুল ইসলাম উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, তার বাসা যাত্রাবাড়ী। আর মেয়ের এইচএসসি পরীক্ষার সিট পড়েছে বারিধারার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। স্বাভাবিক সময়ই এই দীর্ঘ দূরত্বের পথ গণপরিবহণে যেতে হিমশিম খেতে হয়। এ অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন কর্মসূচিতে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে এবং তখন রাস্তায় গণপরিবহণ সংকট দেখা দিলে সময়মতো পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছানো দুষ্কর হবে। তাই পরীক্ষার দিনগুলোতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক আত্মীয়ের বাসায় মেয়েসহ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারপরও এ সময় পথের নিরাপত্তা কেমন থাকবে- তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।

ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী ফারিহা তাসনূভার মা শাহিনা খাতুন বলেন, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশঙ্কা করছেন বিএনপি যে কোনো সময় নাশকতা করতে পারে। বিএনপি কর্মসূচির নামে এক ধরনের নাশকতা করার চেষ্টা করছে, একটি অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে সাংবাদিকরা তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, 'বিএনপি তো সব সময় এটিই করে থাকে। আপনারা ২০১৩-১৪ তে দেখেছেন কী রকম নাশকতা করেছে, জ্বালাও-পোড়াও করেছে, মানুষ হত্যা করেছে। এমনকি গবাদি পশুও হত্যা করেছে। ট্রাক-সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক পর্যন্ত বাদ যাননি।'

শাহিনা খাতুন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই অনুমান করে মনগড়া এ কথা বলেননি। তিনি নিশ্চয় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে যাদের ছেলেমেয়েরা ১৭ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের শেষভাগ পর্যন্ত এইচএসসি পরীক্ষা দেবে।

এই অভিভাবকের আহ্বান, বিএনপি-আওয়ামী লীগ কিংবা জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যাতে অন্তত পরীক্ষার দিনগুলোতে কোনো কর্মসূচি না দেয়। নেতারা যেন সম্মিলিতভাবে এ ব্যাপারে আগাম ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আশ্বস্ত করেন। তা'হলে অন্তত পরীক্ষার্থীরা দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারবেন।

এদিকে শিক্ষার্থীরাও এ ব্যাপারে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে আকুতি জানিয়েছে। মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন- 'আমরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে চাই। আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন কর্মসূচির ঘুঁটি হতে চাই না। আমরা আপনাদেরই সন্তান। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরীক্ষা চলাকালীন আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া বন্ধ করুন।'

নওরীন সুলতানা নামের এক পরীক্ষার্থীর জিজ্ঞাসা, 'পরীক্ষার্থীদের উৎকণ্ঠায় রেখে রাজনৈতিক নেতাদের কী লাভ? 'আমরা রাজনীতি বুঝি না। শুধু পরীক্ষাটা ঠিকমতো ও নিরাপদে দিতে চাই।'

লালমাটিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তপতুন নাহারের শঙ্কা, আন্দোলন কর্মসূচির কারণে কোনো পরীক্ষায় অনুপস্থিতি কিংবা পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছাতে বিলম্বের কারণে শিক্ষা জীবনই থমকে যেতে পারে। এই দুশ্চিন্তায় অনেকের পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও ব্যাঘাত ঘটছে।'

রাজউক কলেজের শিক্ষার্থী জাহিদুল আলম বলেন, 'এ রকম একটা পরীক্ষার মধ্যে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়া যায় কিনা, সেটা রাজনীতিবিদদের ভাবা উচিত। রাজনীতি তো মানুষের জন্য। তাহলে এর জন্য আমরা কেন মূল্য দেব?'

তরুণদের শিক্ষা জীবন নিয়ে ছিনিমিনি না খেলার অনুরোধ জানিয়ে পুরান ঢাকার পরীক্ষার্থী একরামুল হোসেন বলেন, 'এইচএসসি পরীক্ষা শিক্ষা জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্ট। তাই এ পরীক্ষা যাতে আমরা ভালোভাবে দিতে পারি সেজন্য সব রাজনৈতিক দলকে বিষয়টি তা বিবেচনায় রাখা উচিত।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে