সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষায় অক্ষত মহাসড়ক!

সড়কে পানি জমতে না দেওয়া, বাস-বে নির্মাণ গতি ও অতিরিক্ত ওজনবাহী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে এই সাফল্য এসেছে
গাফফার খান চৌধুরী
  ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

এবারই প্রথম বর্ষা মৌসুমে দেশের মহাসড়ক প্রায় শতভাগ অক্ষত রয়েছে। এটিকে বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, অতিরিক্ত ওজন নিয়ে যানবাহন চলাচলে কড়া অবস্থান, বাস বে নির্মাণ, সড়কে পানি জমতে না দেওয়া এবং নষ্ট হওয়া সড়ক দ্রম্নত মেরামত করার কারণে এই সাফল্য এসেছে। হাইওয়ে পুলিশের শক্ত অবস্থানের কারণেই এমন উন্নতি। এ অবস্থা ধরে রাখা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে মহাসড়কে ভোগান্তি থাকবে না।

সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, অতীতে প্রতি বছরই বর্ষায় মহাসড়কে ভোগান্তির সৃষ্টি হতো। বিশেষ করে বর্ষণে মহাসড়কে খানাখন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হতো। দিন যত যেত খানাখন্দ বা গর্তের আকার আরও বড় হতো। মহাসড়কগুলোর উপরিভাগে দেওয়া হয় বিটুমিন যা পানি সহ্য করতে পারে না। পানিতে সড়ক বা মহাসড়ক ভিজে বা স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকলে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করায় দ্রম্নত বিটুমিন উঠে খানাখন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হয়।

সূত্রটি বলছে, খানাখন্দের কারণে স্বাভাবিকভাবেই যানবাহনের গতি কমাতে বাধ্য হন চালকরা। এতে করে মহাসড়কে এই সময় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় মানুষকে। নষ্ট হয়ে যায় যানবাহনে থাকা কাঁচামাল। এতে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, তেমনই নষ্ট সড়ক মেরামতে ব্যয় বাড়ে।

সড়ক গবেষণা কেন্দ্রের সূত্রটি জানায়, মহাসড়কে ভোগান্তি কমাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক কোথাও মহাসড়কে খানাখন্দ বা গর্তের সৃষ্টি হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি প্রয়োজনে আরও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি খানাখন্দের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বা আর্থিক ক্ষতির কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দায়ী থাকবেন বলেও জানানো হয়।

সূত্রটি বলছে, দুর্ঘটনা সংক্রান্ত মামলায় প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করার ঘোষণা দেওয়ার পরই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে।

মহাসড়কের পাশে থাকা সার্ভিস লেন যাতে সবসময় সচল থাকে তার ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এমনকি সার্ভিস লেনে পানি নেমে যাওয়ার ড্রেন যাতে সবসময় খোলা থাকে তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে বলা হয়। এসব নির্দেশনার পর মহাসড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট জেলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিষয়টি চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিং করতে থাকেন। এজন্য এ বছর ভারী বর্ষণের পরও মহাসড়ক বা সার্ভিস লেনে পানি জমেনি। মহাসড়কের কোথাও ভারী খানাখন্দের সৃষ্টি হয়নি।

সরেজমিন ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, শুধু যেসব স্থানে নির্মাণ কাজ চলছে সেসব স্থান ছাড়া মহাসড়কের কোথাও কোনো ধরনের ভোগান্তি নেই। ঢাকার আব্দুলস্নাহপুর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত মহাসড়কের কাজ চলছে। এ সড়কে নির্মাণ কাজ চলার কারণে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। তবে ঢাকা থেকে সাভার হয়ে বাইপাইল, চন্দ্রা, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল হয়ে যমুনা সেতুর পূর্ব পাড় পর্যন্ত মহাসড়কের কোথাও যানজট দেখা যায়নি। এমনকি এ মহাসড়কে আগে যেভাবে যানজট হতো এখন আর হয় না বলে একাধিক যানবাহন চালক জানিয়েছেন। গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের বিভিন্ন চালকের সঙ্গে কথা বলেও মিলেছে এমন তথ্য।

এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেট মহাসড়কেও যানজট নেই বললে চলে। কারণ মহাসড়কে খানাখন্দ বা গর্তের সৃষ্টি হতে পারেনি। হলেও তা দ্রম্নত মেরামত করায় পরিস্থিতি এ বছরের বর্ষায় খারাপ হতে পারেনি।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-মুন্সীগঞ্জ মহাসড়ক ঘুরে দেখা গেছে, ডেমরার কাজলা থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মাঝে মধ্যে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। মহাসড়কটির উন্নয়ন কাজ চলছে। কাজলা থেকে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া পর্যন্ত মহাসড়কের অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ দ্রম্নত শেষ করতে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ চলছে। বিশাল বিশাল কালভার্ট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে মহাসড়ক সংযুক্ত করে পিচ ঢালাই দিলেই কাজ শেষ। মহাসড়কটিতেও সার্ভিস লেন রাখা হয়েছে।

হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক মহাসড়কের দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এতে করে মহাসড়কে যানজট নেই বললেই চলে। মহাসড়কে কোনো যানবাহন আগের মতো দাঁড়াতে পারে না। মহাসড়কে যাত্রী উঠানামার জন্য 'বে' স্থাপন করা হয়েছে। যানবাহনগুলোকে এসব বে ব্যবহার করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে করে মহাসড়কে যানজট কমে আসছে। রাস্তায় যানবাহন বিকল হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে তা রেকার দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আগে রাতে মহাসড়কের নির্ধারিত জায়গায় হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করত। এখন পুরো মহাসড়কেই মোবাইল ডিউটি আছে। মোটর সাইকেল নিয়ে পুলিশ চব্বিশ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে। ফলে কোথাও কোনো ধরনের সমস্যা হলেই সঙ্গে সঙ্গে তার সমাধান হচ্ছে।

হাইওয়ে পুলিশের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ও অপারেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অ্যাডিশাল ডিআইজি) শ্যামল কুমার মুখার্জী যায়যায়দিনকে বলেন, 'প্রতিটি মহাসড়কে কী পরিমাণ ওজন নিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারবে তার পরিসীমা নির্ধারিত করে দেওয়া আছে। নির্ধারিত পরিমাপের চেয়ে বেশি ওজনবাহী যানবাহন চলতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে করে মহাসড়কে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক অনেক কমে এসেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যানবাহনের গতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলাচল করবে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার করা হয়েছে। কোনোভাবেই এর বেশি গতিতে যানবাহন চলতে দেওয়া হচ্ছে না।'

তিনি আরও বলেন, 'মহাসড়কের কোথাও কোনো খানাখন্দ হলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দ্রম্নত মেরামতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এতে মহাসড়কে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভোগান্তি কমেছে। মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে দেওয়া হচ্ছে না। সেতুর টোল পস্নাজায় টোল আদায়ের সূত্র ধরে সৃষ্ট যানজট এড়াতে যানবাহন চালকদের টোলের নির্ধারিত পরিমাণ টাকা আগ থেকেই পকেটে রাখতে বলা হয়েছে। কারণ টাকা ভাংতি করে টোল আদায় করতে গেলে এক মিনিটে এক কিলোমিটার যানজট হয়।'

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ইতোমধ্যেই যানজটপ্রবণ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকার মহাখালী, আব্দুলস্নাহপুর, সায়েদাবাদ, গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী, শনির আখড়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজ, চট্টগ্রামের মিরসরাই, ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি, ফতুলস্না, শ্যামপুর, কুমিলস্নার দাউদকান্দি ব্রিজ, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা, বাইপাইল, কালিয়াকৈর, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়, এলেঙ্গা, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক, ঢাকা-মাওনা ফেরিঘাট এলাকায় ইউটার্ন নির্মাণ ও মহাসড়কের পাশে যানবাহন দাঁড়ানোর 'বে' নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে যানজট একেবারেই সহনীয় পর্যায় এসেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ডক্টর শামছুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিটুমিনের শত্রম্ন হচ্ছে পানি। সড়ক-মহাসড়কে পানি জমতে দেওয়া যাবে না। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণও জরুরি। যেটি সম্প্রতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তবেই মহাসড়কে মানুষের ভোগান্তি কম হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে