সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি নির্ধারণ

৫ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি নীতিমালা

বীরেন মুখার্জী
  ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি একেকটির একেক রকম। ফি নির্ধারণে নেই কোনো আইন, নিয়ম বা নীতিমালা। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত বেতনসহ অন্যান্য ফি আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে অভিভাবকদের। তবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এভাবে ফি আদায় বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একাধিকবার নির্দেশনা দিলেও এর লাগাম টানা সম্ভব হয়নি।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে দেশের বেসরকারি বিদ্যালয় ও পাঠদান প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি বাংলাদেশে পরিবারপিছু শিক্ষা খরচের বোঝা দিয়েছে বাড়িয়ে বলে উলেস্নখ করে সংস্থাটি দাবি করে, এ জন্য শিক্ষায় বৈষম্য বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশের জোগান আসে পরিবারগুলো থেকে, যা শিক্ষা খাতে পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ হার বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। ইউনেসকো বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বেসরকারি উদ্যোগ বেড়ে চলেছে, যারা প্রায় ক্ষেত্রেই বেশি খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা করছে।

দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই সমস্যা সমাধানে ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি নীতিমালা করার জন্য কয়েকজন জেলা প্রশাসক প্রস্তাব দেন। 'শিক্ষানীতি, ২০১০'-এ বিষয়টি (টিউশন ফি নীতিমালা করা) উলেস্নখ ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২০

নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব আনোয়ারুল হক খসড়া নীতিমালা পাঠানোর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে অনুরোধ করেন। এরপর নীতিমালার খসড়া করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নীতিমালা প্রণয়ন উদ্যোগের প্রায় ৫ বছরেও চূড়ান্ত হয়নি নীতিমালাটি।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ৩৬ হাজার ৭১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৪ হাজার ৮১৬টি বেসরকারি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই টিউশন ফি পরিশোধ করতে রীতিমতো নাজেহাল হতে হয় নিম্নআয়ের পরিবারের অভিভাবকদের। দীর্ঘদিন ধরে টিউশন ফি নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদেরা। তাদের ভাষ্য, এ উদ্যোগ কার্যকর হলে দেশের শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অবশেষে শিক্ষা নিয়ে এই বাণিজ্য বন্ধে টিউশন ফি নীতিমালার খসড়া নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আগামীকাল বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসছেন সংশ্লিষ্টরা। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. রবিউল ইসলামের সভাপতিত্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ওই সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ছাড়াও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত থাকবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই নীতিমালার আলোকে সারা দেশের প্রতিষ্ঠানভিত্তিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের টিউশনসহ সব ধরনের ফি আদায় করা হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই নগদ অর্থ আদায় করতে পারবে না। এছাড়া আদায়কৃত অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিলে জমা রাখতে হবে।

জানা যায়, এ নীতিমালার আওতায় এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাসিক বেতন, ভর্তি, সেশন, বোর্ড পরীক্ষার ফরম পূরণসহ মোট ২৬ ধরনের ফি নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোনো অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতে পারবে না। আদায় করা অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিলে জমা রাখতে হবে এবং নির্দেশনা মোতাবেক খরচ করতে হবে।

খসড়া এ নীতিমালায় মহানগর, পৌর জেলা/পৌর উপজেলা এবং মফস্বলের স্কুল ও কলেজের জন্য আলাদা টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দু'টি ভাগ রয়েছে। একটি এমপিওভুক্ত ও অন্যটি নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর নবম-দশম শ্রেণিতে মাসিক বেতন ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণিতে মাসিক বেতন ২৫০ থেকে ৬০০ টাকা এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বেতন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

একইভাবে কলেজ পর্যায়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ১৮০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া স্নাতক পর্যায়ে এ হার ২০০ থেকে ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ হার কলেজ পর্যায়ে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। আর স্নাতক পর্যায়ে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা রাখার কথা বলা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।

এছাড়া অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, টিফিন, ম্যাগাজিন, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, লাইব্রেরি, পরিচয়পত্র, নবীনবরণ, শিক্ষা সফর, উন্নয়ন ফি ইত্যাদি খাতে কত টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আদায় করতে পারবে, এ বিষয়েও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই ফি সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা।

জানা গেছে, নীতিমালায় রসিদ বই ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো অর্থ আদায় করা যাবে না বলেও উলেস্নখ করা হয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত রসিদ বই ছাড়া কোনো অর্থ আদায় করা যাবে না এবং শিক্ষার্থীদের রসিদ প্রদান করতে হবে। বিল, ভাউচার ছাড়া কোনো ব্যয় করা যাবে না।

টিউশন ফি নির্ধারণে নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডক্টর মিল্টন বিশ্বাস বলেন, 'নীতিমালা প্রণয়ন করা খুব জরুরি। কারণ, এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানের এ-সংক্রান্ত খরচের ফারাক খুব বেশি। এটা করলে বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার যে প্রবণতা সমাজে তৈরি হয়েছে, তার পথ বন্ধ হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে