সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

খুঁড়িয়ে চলছে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র

নেই উলেস্নখযোগ্য কোনো অর্জন, চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ অপ্রতুল, 'নামসর্বস্ব' সংস্থায় পরিণত
রেজা মাহমুদ
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আপডেট  : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০৬
স্পারসো'র একমাত্র অর্জন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে স্পেস টেকনোলজি নিয়ে কাজ করা দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন কেন্দ্র (স্পারসো)। প্রায় ৪৩ বছর আগে মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে স্পারসো প্রতিষ্ঠিত হলেও নেই উলেস্নখযোগ্য কোনো অর্জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চরম জনবল সংকট ও দুর্বল আইনি কাঠামোসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনাগ্রহ স্পারসোকে 'নাম সর্বস্ব' সংস্থায় পরিণত করেছে। অনুদানে তৈরি পুরনো একটি ভূ-উপগ্রহ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (সাটেলাইট ডাটা গ্রহণ ও সংরক্ষণ) ছাড়া আর কোনো প্রযুক্তিগত অবকাঠামো নেই। এই দীর্ঘ সময়ে নিজস্ব স্যাটেলাইট তৈরি কিংবা মহাকাশ প্রযুক্তি উন্নয়নে কোনো গবেষণা কার্যক্রমও পরিচালনা করেনি সংস্থাটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ ছাড়া এ খাতে দেশের উলেস্নখযোগ্য কোনো অর্জন নেই। তবে স্যাটেলাইট তৈরি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কিংবা উৎক্ষেপণ কোনোটির সঙ্গে দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সম্পৃক্ততা নেই। ফলে আবহাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের স্যাটেলাইট ডাটা প্রাপ্তি ও পর্যবেক্ষণ এখনো বিদেশি সংস্থার ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারত চাঁদে সফল পদার্পণে আলোচনায় আসে দেশের মহাকাশ গবেষণা ও অগ্রগতি। এ বিষয়ে জানতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে স্পারসোর প্রধান কার্যালয়ে গেলে সংবাদকর্মীদের প্রবেশের বিধিনিষেধ রয়েছে বলে জানান সেখানকার কর্মকর্তারা। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে, তথ্য কর্মকর্তা রুবেল কান্তি দে বলেন, 'এই মুহূর্তে পরিচালক কিংবা শীর্ষ কোনো কর্মকর্তা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন না।' এমনকি সাংবাদিকদের অফিসে প্রবেশও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে জানান তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের চাঁদে সফল অবতরণের পর এই কড়াকড়ি আরোপ করেছে সংস্থাটি। সংস্থাটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ১৬টি কারিগরি শাখা, ৫টি সহায়ক ও একটি আঞ্চলিক দূর অনুধাবন কেন্দ্র নিয়ে পরিচালিত হয় স্পারসো। দেশের ভূমি মানচিত্র পর্যবেক্ষণসহ দূর অনুধাবনে ছোট ছোট কিছু প্রকল্প পরিচালিত হলেও মহাকাশ গবেষণা-কার্যক্রম একবারে শূন্যের কোঠায়। এদিকে, সংস্থাটির বর্তমান কর্মকর্তারা বাজেট সংকট ও অপর্যাপ্ত বরাদ্দের কথা বললেও সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন গুরুত্বহীনতা আর অদূরদর্শিতার এমন উদাহরণ নজিরবিহীন। কারণ প্রতিবেশী দেশ ভারত ৩য় বারের মতো চাঁদের অরবিটে মহাকাশ যান পাঠিয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিকে। সবশেষ চন্দ্রাযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণেও সফল হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬১৪ কোটি রূপি। অথচ দেশের মহাকাশ বিজ্ঞান এখনো প্রাথমিকের পড়াশোনা শুরু করেনি। যদিও ২০২০ সালে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে ২০৪১ পর্যন্ত মহপরিকল্পনা হাতে নেয় স্পারসো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্থাটির শীর্ষ এক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, 'দুর্বল আইনি কাঠামো ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ ছড়া বেশিরভাগ প্রকল্পই ব্যয়বহুল কিন্তু সে অনুপাতে অর্থ বরাদ্দ মিলছে না। তবে করোনার কারণে স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা যা ২০২৪ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।' ওয়েবসাইটের তথ্যনুযায়ী, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় রয়েছে- ২টি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ, দেশের ভূ-পর্যবেক্ষণে স্যাটেলাইট নির্মাণের জন্য প্রযুক্তি উন্নয়ন ও কক্ষপথে স্থাপনে সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম শুরু করা। এর সময় ধরা হয়েছে ২০২৪ সাল। কিন্তু ৩ বছরে এর কোনো কিছুই শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে মধ্যে মেয়াদি প্রকল্প যেমন নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রযুক্তি উন্নয়নে পরীক্ষাগার ও নিজস্ব দূর অনুধাবন স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন কার্যক্রম পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্পারসোর ওই কর্মকর্তার মতে, এই সীমিত জনবল দিয়ে বিশেষ অল্পসংখ্যক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দিয়ে একটা জাতীয় সংস্থার ১৬টি কারিগরি শাখা চালানো অসম্ভব। জানা গেছে, বছরের পর বছর কয়েকজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা দিয়ে স্পারসোর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রধান, মুখ্য ও ঊর্ধ্বতন ও সহকারী ৪ পদে মোট ৬৩ জন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ২৩ জন। যার মধ্যে ১২ জন মুখ্য কর্মকর্তার পদে রয়েছে ২ জন এবং ১৬ জন সহকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নেই একজন কর্মকর্তাও। বেশিরভাগ কর্মকর্তা ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ পেলেই চাকরি ছেড়ে দেন। এদিকে, দেশের মহাকাশ প্রযুক্তির অন্যতম ব্যবহারকারী একই মন্ত্রণালয়ের আবহাওয়া অধিদপ্তর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আবহাওয়াবিদ বলেন, 'উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট ডাটা পেতে তাদের ৩টি বিদেশি সংস্থার স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন মেয়াদে চুক্তিতে বড় অঙ্কের অর্থ দিতে হয় এসব সংস্থাকে। বর্তমানে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও নেদারল্যান্ডসের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে আবহওয়া বিশ্লেষণ ও পূর্বাভাস দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু সাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, কিন্তু এতে আবহাওয়া পূর্বাভাস পাওয়ার কোনো প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। হয়তো হাই (৩৫ হাজার ফিট) ও কাঙ্ক্ষিত অরবিট না পাওয়ায় আবহাওয়া পূর্বাভাস বা পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয়নি। যদিও যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তাতে সহজেই এটা করা যেত বলে মনে করেন তিনি। এর বাইরেও বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে স্পেস টেকনোলজি খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও লাভজনক। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মাল্টি বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে এ খাতে আধিপত্যে বিস্তারে। নাসার হিসেবে স্পেস টেকনোলজিতে প্রতি ডলার বিনিয়োগে ৩ থেকে ৪ গুণ লাভ হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মেধাবী কর্মীদের ব্যবহারে এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন। যার জন্য প্রয়োজন নীতি সংশোধন। স্পারসোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বাকিটা নির্ভর করছে নীতিনির্ধারকদের ওপর। \হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে