সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবরোধের ছক ঠেকাতে সতর্কতা

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপির কর্মীরা ঢাকায় এসে কোন নেতার শেল্টার নিচ্ছে, তাদের দিয়ে তারা ঢাকা অবরোধের কী ধরনের ছক কষছে- সোর্সের মাধ্যমে গোয়েন্দারা তা জানার চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে প্রযুক্তিগত কৌশলও কাজে লাগানো হচ্ছে
সাখাওয়াত হোসেন
  ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

বিএনপি গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের আগে সারাদেশ থেকে তাদের নেতাকর্মীদের যেভাবে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল এবারও সেই একই কৌশল নিয়েছে। ২৬ অক্টোবরের মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের একটি বড় অংশকে ঢাকায় ঢোকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে শেষ সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রতিবন্ধকতা মহাসমাবেশে যোগ দেওয়া নেতাকর্মীদের ঠেকাতে না পারে। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ শেষে বিএনপি নেতাকর্মীদের নিয়ে সচিবালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাও এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে ঢাকা অচল করে দেওয়ার ছক এঁটেছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে সরকারকে অবহিত করার পর অবরোধের পরিকল্পনা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, হেফাজত ইসলাম যেভাবে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে ঢাকা অচল করার ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই একই কৌশলে বিএনপি যাতে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে এজন্য সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে সড়ক অবরোধ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করার আগেই অপতৎপরতা রুখে দেওয়া যায়। এ ধরনের ছক বাস্তবায়নের আগেই যাতে ভন্ডুল করে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের চেয়ে নানা কৌশলের গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে।

এদিকে সমাবেশ শেষে বিএনপি ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি দিতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যুবলীগ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ পরিস্থিতিতে দু'দলের মুখোমুখি অবস্থানে রাজনৈতিক আন্দোলন সংঘাত-সহিংসতায় রূপ নিতে পারে বলেও গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছেন। তাই সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও কর্মচাঞ্চল্য যাতে স্বাভাবিক রাখা যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে ব্যাপারে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছে।

পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে কেউ যাতে রাজপথে

নেমে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, স্থায়ীভাবে রাস্তা বন্ধ করে সভা-সমাবেশ, যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা কিংবা অগ্নিসংযোগসহ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে গোটা ঢাকায় গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার হটানোর একদফা দাবিতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে আন্দোলনের নামে তান্ডব চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যার কিছু আলামত এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। তাই ঢাকার অলিগলি, রাজপথ ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া কেউ যাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে।

প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আড়াই মাস বাকি থাকলেও তাতে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখনো অটল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে তারা তাতে অংশ নেবে না বলে সাফ জানান দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে বাধ্য করতে সরকারবিরোধী এ দলটি স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা করবে। অলআউট কর্মসূচি ঘোষণা করলে দলের নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের মোকাবিলা করতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মাঠে নামার আগাম ঘোষণা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলো সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ারও জোরালো আশঙ্কা রয়েছে। তাই দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই সরকার আগেভাগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছে।

তবে সরকারের এ 'স্ট্যাটিজিক পস্ন্যানে' বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অহেতুক হয়রানি-নির্যাতনের কোনো ছক নেই বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতনরা দাবি করেছেন। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বানচাল, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে সৃষ্ট নৈরাজ্য ঠেকিয়ে নগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই অ্যাকশন পস্ন্যানের আওতায় রাজপথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অস্ত্রধারী পলিটিক্যাল ক্যাডারদের ধরপাকড় করা হবে। বিশেষ করে নানা উসকানিতে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার মিশনে নামা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রকারী চক্র এবং এর নেপথ্য মদদদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর 'অ্যাকশনে' নামা হবে।

পুলিশের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত সময়ে বিভিন্ন সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় শুধু সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও এখন থেকে এ ব্যাপারে আরও কঠোর হবে পুলিশ। এ ধরনের ঘটনা দ্রম্নত তদন্ত করে এর নেপথ্য মদদদাতা ও হুকুমদাতাদেরও আসামি করা হবে।

এদিকে ঢাকা অবরোধ কিংবা আন্দোলনের নামে নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে কোনো ধরনের অপচেষ্টা রুখে দিয়ে হার্ডলাইনে থাকার বিষয়টি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আগেভাগেই স্পষ্ট জানান দিয়েছেন। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে এরই মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কা ও জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশ কিভাবে সামাল দেবে- সংবাদমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, যে কোনো শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন, মিছিল-মিটিং সমাবেশ করার অধিকার সবার রয়েছে। কিন্তু যদি কেউ এটির আড়ালে কোনো সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে, পুলিশ কঠোর হাতে তা দমন করবে। ডিএমপির বিভিন্ন থানার ওসিরা এ ব্যাপারে হার্ডলাইনে থাকার নানা কৌশলের কথা জানান। যদিও এসব কৌশলের বিষয়ে খোলাসা করে কিছু বলতে চাননি।

তবে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে কোনো নাশকতার আশঙ্কা নেই বলে মনে করেন ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশিদ। তবে পুলিশের চেকপোস্ট ও অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। হারুন বলেন, চেকপোস্ট বসানো পুলিশের রুটিন কাজ। পাশাপাশি আদালতের পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেপ্তারের কাজও নিয়মিত চলবে।

এদিকে মাঠপর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপির কর্মীরা ঢাকায় এসে কোনো নেতার শেল্টার নিচ্ছে, তাদের দিয়ে তারা ঢাকা অবরোধের কি ধরনের ছক কষছে- সোর্সের মাধ্যমে গোয়েন্দারা তা জানার চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে প্রযুক্তিগত কৌশলও কাজে লাগানো হচ্ছে। উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে বা সন্দেহজনক কোনো গতিবিধি পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট নেতাদের গোয়েন্দা জালে বন্দি করা হচ্ছে। যাতে অবরোধ ছক বাস্তবায়নের আগেই এর নেতৃত্বে থাকা নেতাকর্মীদের দ্রম্নত গ্রেপ্তার করা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এ মিশন সফল করতে থানা পুলিশের সঙ্গে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) ও ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টসহ (সিআইডি) সার্বিক কার্যক্রম সমন্বয় করছে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে রিজার্ভ ফোর্সেরও সহায়তা নেওয়া হবে। এ প্রস্তুতি চূড়ান্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে ঢাকা অবরোধ ঠেকাতে সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের কথা বললেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা তা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের ভাষ্য, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই আবর্তিত হবে আগামী কয়েক মাসের রাজনীতি। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পালস্না দিয়ে জোরদার হবে বিএনপির তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এসব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, 'সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে দলের নেতাকর্মীদের ঢাকায় এসে বসে পড়তে বলা হয়নি। ২৮ তারিখে কর্মসূচির পরে যে যার জায়গায় চলে যাবে এবং পরবর্তী কর্মসূচির জন্য তারা অপেক্ষা করবে। ২৮ তারিখে এমন কোনো কর্মসূচি দেওয়া হবে না যে ঢাকায় বসতে হবে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে