সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
হামাস-ইসরাইল সংঘাত

গাজায় হামলা আরও বাড়াবে ইসরাইল

রাতভর অভিযানে নিহত ৫৫, বাদ যায়নি পশ্চিম তীরও হ ইসরাইলি বোমা হামলায় গাজার ২৬টি মসজিদ ধ্বংস হ গাজায় প্রবেশ করল ত্রাণবাহী আরও ১৭ ট্রাক হ চিকিৎসকদের গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান রেডক্রসের
যাযাদি ডেস্ক
  ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
শনিবার রাতভর ইসরাইলি বিমান হমলায় ক্ষতিগ্রস্ত গাজায় এক নারীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন উদ্ধারকর্মীরা -ইন্টারনেট

গত ৭ অক্টোবর থেকে অধিকৃত গাজায় লাগাতার বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। তারপরও তারা হুমকি দিয়েছে, বিমান হামলার তীব্রতা আরও বাড়াবে। তাই যারা গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থান করছে, তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে দক্ষিণে সরে যেতে বলেছে ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, হামলা জোরদারের ফলে যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে ইসরাইলি বাহিনীর ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। যুদ্ধের পরবর্তী ধাপে ইসরাইল গাজায় স্থল অভিযান চালাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংবাদসূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আল-জাজিরা, এএফপি

টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখন্ডে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। তাদের নির্বিচার হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না গাজার স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ ও গির্জাও। অবিরাম এই হামলায় গাজায় নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে চার হাজার। ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)-এর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি শনিবার জানিয়েছেন, 'আমরা গাজা ভূখন্ডে আমাদের হামলা আরও তীব্র করব, যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের বাহিনীর জন্য ঝুঁকি কমিয়ে আনব এবং আমরা আজ থেকেই আক্রমণ বাড়াতে যাচ্ছি।' আর তাই গাজা শহরের বাসিন্দাদের 'তাদের নিরাপত্তার জন্য আরও দক্ষিণে সরে যেতে' আহ্বান জানিয়েছেন হ্যাগারি।

রাতভর অভিযানে নিহত ৫৫

হামাস জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের এক রাতের অভিযানেই ৫৫ জন নিহত হয়েছে। হামাসের প্রেস অফিস জানিয়েছে, হামলায় গাজায় ৩০টির বেশি বাড়ি-ঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।

পশ্চিম তীরে একটি শরণার্থী শিবিরেও হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিন শরণার্থীদের জন্য কাজ করা জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (ইউএনআরডবিউএ) জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে পাঁচ জনই শিশু। পশ্চিম তীরের নুর

শামস শরণার্থী শিবিরে হামলা চালানো হয়েছে। এক বিবৃতিতে ইউএনআরডবিউএ আরও জানিয়েছে, এক ইসরাইলি সেনাও নিহত হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

এদিকে, ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের জেনিনে হামাসের একটি সেল লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। ফিলিস্তিনি গণমাধ্যম জানিয়েছে, স্থানীয় সময় রোববার ভোরে হামলায় অন্তত দুজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছে।

অপরদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, গাজায় ইসরাইলের সম্ভাব্য স্থল অভিযানের বিষয়টি নিয়ে ইসরাইলিদের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, তিনি গাজায় ওই অভিযান বিলম্বিত করতে বলেছেন কি-না। জবাবে বাইডেন শুধু বলেছেন, 'ইসরাইলিদের সঙ্গে আলোচনা করছি।'

ইসরাইলি বোমা হামলায় গাজার

২৬টি মসজিদ ধ্বংস

ইসরাইলের বোমা হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ২৬টি মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে চালানো অবিরাম হামলায় এসব মসজিদ ধ্বংস হয়। ইসরাইলের নির্বিচার এই হামলা থেকে বাদ যাচ্ছে না গাজার স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ ও গির্জাও।

গাজার 'এনডাউমেন্টস অ্যান্ড রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স' মন্ত্রণালয় শনিবার জানিয়েছে, অবরুদ্ধ এই ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের বেশিরভাগ এলাকায় ইসরাইলি বিমান হামলায় আরও কয়েক ডজন মসজিদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ইসরাইলি যুদ্ধবিমান গাজার এই মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তর, মন্ত্রণালয়ের কোরআন, রেডিও স্টেশন এবং একটি গির্জাও ধ্বংস করেছে।

গাজায় আগ্রাসন বন্ধ করতে ও ইসরাইলকে বেসামরিক মানুষ, মসজিদ ও গির্জার বিরুদ্ধে অপরাধমূলক আচরণের জন্য জবাবদিহি করতে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ইসলামিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে জরুরিভাবে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে গাজার এনডাউমেন্টস অ্যান্ড রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়।

ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর দাবি, পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থী শিবিরে অবস্থিত আল-আনসার মসজিদে হামলায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদের বেশ কয়েকজন 'সন্ত্রাসী' নিহত হয়েছে। তারা হামলার পরিকল্পনা করার জন্য কমান্ড সেন্টার হিসেবে ওই ভবনটিকে ব্যবহার করে আসছিল। অবশ্য গাজার মসজিদগুলোতে ইসরাইলি বাহিনীর হামলা খুবই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং সর্বশেষ দুদিন আগে ইসরাইলের হামলায় ধসে পড়ে গাজার ঐতিহাসিক আল-ওমারি মসজিদ।

গাজায় প্রবেশ করল ত্রাণবাহী

আরও ১৭ ট্রাক

দখলদার ইসরাইলের বিমান বাহিনীর নির্বিচার হামলায় বিপর্যস্ত গাজাবাসীর জন্য পাঠানো আরও ১৭টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। রোববার মিসরের রাফাহ ক্রসিং থেকে গাজার ভেতর ঢোকে ট্রাকগুলো। এর আগে শনিবার যুদ্ধ শুরুর পর বিভিন্ন ত্রাণ নিয়ে গাজায় যায় ২০টি ট্রাক। রোববার যেসব ট্রাক গাজায় গেছে, সেগুলোর মধ্যে অতিপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। এদিন কোনো খাদ্য বা জ্বালানি পাঠানো হয়নি।

মিসর থেকে পণ্যবাহী বড় এই ট্রাকগুলো রাফাহ ক্রসিং অতিক্রম করে মিসর ও ফিলিস্তিনি গেটের মাঝামাঝি যায়। এরপর সেখানে আসে ফিলিস্তিনি ট্রাক। এরপর ওই ট্রাকগুলোতে ত্রাণগুলো বোঝাই করা হয়।

গাজার চিকিৎসকরা কয়েকদিন ধরে জানাচ্ছেন, তাদের জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রয়োজন। কারণ তাদের কাছে যেসব মজুদ ছিল, সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে যে জিনিসটির সবচেয়ে বেশি অভাব দেখা দিয়েছে, সেটি হলো অ্যান্টিসেপটিপ। এই অ্যান্টিসেপটিপের অভাবে গাজার অনেক হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকরা ভিনেগার ব্যবহার করেছেন।

গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলের বিভিন্ন বসতিতে হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এই হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে খাদ্য, জ্বালানি এবং পানিসহ সব প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরাইল। অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে গাজার হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা ধসে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে। তা সত্ত্বেও মিশরের রাফাহ ক্রসিং দিয়ে কোনো জ্বালানি প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরাইল।

'চিকিৎসকদের প্রবেশের অনুমতি দিন'

মিশর হয়ে গাজার ভেতরে চিকিৎসকদের যেন প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি ইসরাইলের প্রতি এমন আহ্বান জানিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে রেডক্রসের কর্মকর্তা সারাহ ডেভিস বলেন, 'গাজায় এই মুহূর্তে নিয়মিত ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা ও ত্রাণ পৌঁছানো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে চিকিৎসা কর্মী ও সার্জিকাল টিমও গাজার ভেতরে যেতে দেওয়া প্রয়োজন, যেন তারা হাসপাতালগুলোতে তৈরি হওয়া চাপ কমাতে পারে।' তিনি জানান, ইসরাইলি বাহিনীর অবরোধ থাকায় গাজার ভেতরে হাসপাতালগুলো পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানকার চিকিৎসকদের। অবরোধের কারণে জালানি শেষ হয়ে যাওয়ায় বিদু্যৎ নিয়েও ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে, যার ফলে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

অপরদিকে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফাহ ক্রসিং দিয়ে মিশর থেকে গাজার ভেতরে শনিবার খাবার, পানি ও জরুরি ওষুধ নিয়ে ২০টি ট্রাক প্রবেশ করার অনুমতি দেয় ইসরাইলি বাহিনী। জাতিসংঘ আশা করছে, আরও কিছু ট্রাক প্রবেশ করার অনুমতি দেবে ইসরাইল। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান মার্টিন গ্রিফিথ আশা করছেন, আরও অন্তত ২০ থেকে ৩০টি ট্রাক গাজার ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।

উলেস্নখ্য, শনিবার গাজার ভেতরে যে ২০টি ট্রাক প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোতে যে পরিমাণ ত্রাণ ও খাবার গাজায় ঢুকেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। দুই সপ্তাহ আগে গাজায় পরিপূর্ণ অবরোধ আরোপ করার পর শনিবারই প্রথম ত্রাণ ও ওষুধ নিয়ে ট্রাক প্রবেশ করতে পেরেছে গাজার ভেতরে।

উলেস্নখ্য, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অবৈধ বসতি লক্ষ্য করে নজিরবিহীন হামলা চালায় গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। হামাস বলেছে, আল-আকসা মসজিদে হামলা ও ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রতিশোধ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে। হামাসের সেই হামলার পর থেকেই গাজায় বিমান হামলা চালানো শুরু করে ইসরাইলি বিমান বাহিনী। তাদের এ নির্বিচার হামলায় এখন পর্যন্ত সাড়ে চার হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক হাজার ৭৫৬ শিশুও রয়েছে। যদিও ইসরাইল দাবি করছে, তারা হামাসের অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। তবে হামাসের যোদ্ধাদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেখানকার বেসামরিক মানুষ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে