সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
ইসরাইল-হামাস সংঘাত

গাজায় রাতভর 'রক্তের হোলি'

গাজায় নির্বিচার বোমা হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা পাঁচ হাজার পার, এক দিনেই চার শতাধিক হ গাজায় ত্রাণের ট্রাকের তৃতীয় বহর হ মাত্র তিন দিন চলার মতো জ্বালানি রয়েছে গাজায় : জাতিসংঘ
যাযাদি ডেস্ক
  ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
ইসরাইলি হামলায় আহত এক শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবিটি সোমবার গাজার খান ইউনিস থেকে তোলা -ইন্টারনেট

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় 'রক্তের হোলি'তে মেতে উঠেছে ইসরাইল। রোববার রাতভর মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে তীব্র বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। একই সময় তারা দক্ষিণ লেবাননেও হামলা চালিয়েছে। গাজার উত্তরের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের কাছে একটি বাড়িতে এদিন বোমা হামলায় বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরাইলের হামলায় সোমবার পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৮৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সংবাদসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আল-জাজিরা, এএফপি

গত ৭ অক্টোবর গাজার হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলে হামলা চালিয়ে এক হাজার চার শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। ইসরাইল থেকে গাজায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ২১২ জনকে। ওইদিন থেকেই গাজায় তীব্র আকাশ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। দেশটি কয়েকদিন ধরে গাজায় স্থল অভিযানের প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। এজন্য তারা গাজার চারপাশের বেড়ার কাছে ট্যাংক এবং সেনা জড়ো করে রেখেছে। তবে করব-করব করেও এখনো স্থল অভিযান শুরু করেনি ইসরাইল।

অন্যদিকে, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদোলস্নাহিয়ান রোববার রাতে ফোনে কথা বলেছেন। তারা গাজার ওপর ইসরাইলের নৃশংস হামলা বন্ধের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে হামাসের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। ইসরাইলকে সতর্ক করে দিয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, গাজায় হামলা না থামালে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ইসরাইলকে সামরিক সমর্থন দেওয়ার জন্য এ সময় আমেরিকাকেও দোষারোপ করেছেন আবদোলস্নাহিয়ান।

এদিকে, গাজার পাশাপাশি লেবাননে হিজবুলস্নাহর সঙ্গেও ইসরাইলের সংঘাত বিস্তার লাভ করছে। সোমবার দিনের শুরুতে ইসরাইলের বিমান লেবাননে হিজবুলস্নাহ দুটি সেলে আঘাত হানে। এই দুটো সেল থেকে ইসরাইলে ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। হামলায় নিজেদের এজন যোদ্ধা নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে হিজবুলস্নাহ। এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য দেয়নি সশস্ত্র সংগঠনটি। ইসরাইলের সেনাবাহিনী থেকেও হিজবুলস্নাহ লক্ষ্যবস্তুতে হামলার

কথা জানানো হয়েছে।

ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যা ওই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থে উলেস্নখযোগ্য ঝুঁকি আরোপ করছে বলে সতর্ক করেছে ওয়াশিংটন। যে কারণে সেখানে 'টার্মিনাল হাই অ্যালটিটিউড এরিয়া ডিফেন্স' বা থাড প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন। এ ছাড়া পারস্য উপসাগর অঞ্চলে অতিরিক্ত 'প্যাট্রিয়ট' আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হবে বলে পেন্টাগন জানিয়েছে। ওই অঞ্চলে মার্কিন সেনাদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার জবাবে এসব ব্যবস্থা মোতায়েন করা হচ্ছে।

গাজায় ইসরাইল হামলায় নিহতের

সংখ্যা পাঁচ হাজার পার

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের নির্বিচার বোমা হামলায় নিহত বেড়ে পাঁচ হাজার ৮৭ জনে পৌঁছেছে। তাদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি রয়েছেন। সোমবার গাজার হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ৭ অক্টোবর হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে পাঁচ হাজার ৮৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে দুই হাজার ৫৫ জন শিশু ও এক হাজার ১১৯ জন নারী রয়েছেন। এ ছাড়া ইসরাইলের হামলায় গাজায় ১২টি হাসপাতাল ও ৩২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব চিকিৎসাকেন্দ্রে জ্বালানির তীব্র ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি ইসরাইলি বিমান হামলায় ধসে যাওয়া শত শত ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচে ৮৩০ শিশুসহ প্রায় দেড় হাজার মানুষ আটকা পড়েছে।

হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর নির্বিচার বোমা হামলায় ৫৭ চিকিৎসক নিহত ও আরও ১০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী আহত হয়েছেন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় উপত্যকায় ১৮২ শিশুসহ ৪৩৬ জন মারা গেছেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় এক দিনে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা এটি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের বোমা হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। উপত্যকাজুড়ে আহতদের চিকিৎসার জন্য জরুরি রক্ত সহায়তা দরকার বলে জানানো হয়েছে।

গাজায় ত্রাণের ট্রাকের তৃতীয় বহর

এদিকে, মিশর থেকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার উদ্দেশ্যে রাফাহ ক্রসিংয়ে প্রবেশ করেছে ত্রাণবাহী ট্রাকের তৃতীয় একটি বহর। সোমবার রাফাহ ক্রসিংয়ে অবস্থানরত একজন ত্রাণকর্মী ও দুটি নিরাপত্তা সূত্র ত্রাণবাহী ট্রাকের গাজায় ঢোকার তথ্য জানিয়েছেন।

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি অব্যাহত হামলায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মাঝেই গত কয়েকদিন ধরে গাজার সঙ্গে মিশরের একমাত্র সীমান্ত রাফাহ ক্রসিংয়ে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আটকা পড়েছে অনেক ট্রাক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের গাজায় ত্রাণসামগ্রী প্রবেশের অনুমতি দিতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানানোর পর শনিবার প্রথম দফায় ত্রাণবাহী ২০টি ট্রাক অবরুদ্ধ উপত্যকায় প্রবেশ করে। পরে রোববার আরও ১৪টি ত্রাণের ট্রাক গাজায় পৌঁছায়। ইসরাইলের নির্বিচার হামলার কারণে সীমান্তের ওপারে মিশরীয় ভূখন্ড থেকে ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো এতদিন গাজায় প্রবেশ করতে পারেনি।

গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এড়াতে আরও শত শত ত্রাণের ট্রাকের প্রয়োজন জানিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ইসরাইলি কর্তৃপক্ষকে রাফাহ ক্রসিংয়ে হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এরপরই সোমবার ত্রাণবাহী কয়েকটি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে বলে সেখানকার দাতব্যকর্মী ও নিরাপত্তা সূত্রগুলো জানিয়েছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলেছেন, গাজায় প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন প্রায় ১০০টি ট্রাকের প্রয়োজন। ২৩ লাখ মানুষের অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় খাদ্য, পানি এবং জ্বালানির মজুদ দ্রম্নত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

মাত্র তিন দিন চলার মতো জ্বালানি

রয়েছে গাজায় : জাতিসংঘ

ইসরাইলি বিমান বাহিনীর টানা বিমান হামলায় বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আর তিন দিন চলার মতো জ্বালানি অবশিষ্ট রয়েছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা 'ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নেয়ার ইস্ট' (আনরোয়া) রোববার এক বিবৃতিতে এই সতর্কবার্তা দিয়েছে।

আনরোয়ার প্রধান নির্বাহী ও জাতিসংঘের কমিশনার জেনারেল ফিলিপ ল্যাজারিনি স্বাক্ষরিত সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আর মাত্র তিন দিনের মধ্যে গাজা উপত্যকার জ্বালানির মজুদ শেষ হয়ে যাবে। যদি জ্বালানি শেষ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে উপত্যকায় বিদু্যৎ থাকবে না, পানি থাকবে না, হাসপাতাল এবং রুটির দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে, উপদ্রম্নত এলাকাগুলোতে ত্রাণও পৌঁছাতে পারবে না।'

ল্যাজারিনি জানান, ইসরাইলের বিমান বাহিনী গাজায় অভিযান শুরুর পর গত ১৬ দিয়ে ১০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি জাতিসংঘ পরিচালিত বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রতিদিনই বাড়ছে এই সংখ্যা। জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, 'প্রতি মুহূর্তে অবনতি ঘটছে গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি। আমি এই যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অনুরোধ করছি, শিগগরিই উপত্যকায় জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করুন। যদি তা না হয়, সেক্ষেত্রে সামনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখতে হবে আমাদের।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে