সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধিজীবী নিধনের চক্রান্ত শুরু করে পাকবাহিনী

বীরেন মুখার্জী
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী ঢাকা দখলের জন্য লড়াই আরও জোরদার করে। একদিকে ঢাকার আকাশ মিত্রবাহিনীর দখলে আর অন্যদিকে অন্ধকার শহরে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় হানাদার পাকবাহিনী জড়সড়। রণাঙ্গনে 'মুক্তি' শব্দটি নিজেদের প্রবল প্রতাপশালী মনে করা পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়।

এই দিন লন্ডনের দৈনিক পত্রিকা 'টাইমস' এবং 'ডেইলি মেল' সম্পাদকীয় মন্তব্যে উলেস্নখ করে, পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যদের এখন আত্মসমর্পণ করাই ভালো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য যেন অনুগ্রহ করে আরও ২৪ ঘণ্টা সময় দেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিলিস্নতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, 'সব ধর্মের মানুষই সমানভাবে আমাদের ভাই। এই মহান আদর্শ রক্ষার জন্য আপনারা এবং আমরা সংগ্রাম করছি।'

রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার '৭১ এর দশ মাস' গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই দিন পাকিস্তান ও তাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ

বন্ধের আলোচনা চালাচ্ছিল। কারণ, তারা বুঝে যায়, এই যুদ্ধে পাকিস্তানের জয়ের সম্ভাবনা একদমই নেই। পরাজয় নিশ্চিত জেনে হানাদাররা হয়ে উঠেছিল আরও হিংস্র।

একাত্তরের এই দিন রাতে ঢাকায় রাও ফরমান আলীর নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সূচনা করে পাকবাহিনী। মিশনের শুরুতেই হানাদাররা শান্তিনগরের চামেলীবাগের ভাড়া বাড়ি থেকে প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় তুলে নেয়। সংবাদ সংস্থা পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের (পিপিআই) প্রধান সংবাদদাতা নিজামউদ্দিন এবং প্রধান প্রতিবেদক ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমের সংবাদদাতা সৈয়দ নাজমুল হককেও তাদের নিজ নিজ বাসা থেকে পাকিস্তান বাহিনীর দোসর কুখ্যাত আলবদর-আলশামস বাহিনী তুলে নিয়ে যায়।

একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, নড়াইলসহ বিভিন্ন এলাকা। মিত্রবাহিনীর জঙ্গিবিমান ঢাকা বেতার কেন্দ্র ও কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের ওপর বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। উত্তরাঞ্চলে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

বাংলাদেশ সরকার কুমিলস্না ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করে এই দিন। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি যুক্ত সামরিক কমান্ডো গঠন ও কীরূপ রণকৌশল গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে কয়েক দিনের আলাপ-আলোচনার পর দুই সরকারের মধ্যে এই দিন একটি চুক্তি সই হয়।

পরাজয়ের আশঙ্কায় একাত্তরের এই দিন লে. জেনারেল নিয়াজি ঢাকা থেকে পাকিস্তানে পালানোর পাঁয়তারা করে। কিন্তু তার গোপন অভিসন্ধি বিবিসি ফাঁস করে দেয়। এই দিন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দম্ভভরে তিনি বলেন, 'কোথায় বিদেশি সাংবাদিকরা। আমি তাদের জানাতে চাই, আমি কখনো আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাব না।'

ভারতীয় নৌবাহিনী বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বন্দর মোংলার চালনা মুক্ত করে এই দিন খুলনার ফুলতলা পর্যন্ত পৌঁছে। কুষ্টিয়া তখন মুক্ত হওয়ার পথে। দিনাজপুর শহর মুক্ত করার জন্য চার দিন ধরে যুদ্ধ চলমান। এদিকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনী পৌঁছে যায় ঢাকার উপকণ্ঠে।

একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে দায়িত্ব পালন করছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমীন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে মৃতু্যকে তোয়াক্কা না করে প্রতিরোধ গড়ে তিনি শহীদ হন। এদিন মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ করে। মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটি জাহাজভর্তি পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে। একটি জাহাজে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সিঙ্গাপুর পালানোর পথে মিত্র নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

ময়মনসিংহ শহর মুক্ত হওয়ার আগে এই দিন পাকিস্তান বাহিনী ডাকবাংলো, কেওয়াটখালী, বড়বাজার, নিউমার্কেট, কালীবাড়ী ও সাহেব আলী রোড এলাকায় বহু নিরীহ মানুষ হত্যা করে। স্বাধীনতার এই জেলায় ১২টি বধ্যভূমির সন্ধান মেলে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ হারান প্রায় দুই হাজার ভারতীয় সৈনিক। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্দেশে দেওয়া এক বাণীতে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'সমগ্র দেশ আপনাদের প্রশংসায় মুখর। সমগ্র জাতি আপনাদের পেছনে রয়েছে। লড়াই চালিয়ে যান। আমাদের জয় সুনিশ্চিত।'

বাংলাদেশের বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে, তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সরব হয়ে ওঠে, যার অধিকাংশ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। ১০ ডিসেম্বর ইউএনআই সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিদূতদের অপেক্ষায় এখন ঢাকা। বিবিসির সংবাদদাতা বলেন, ভারতীয় বাহিনীর আগমনের মুখে উত্তেজনা বেড়ে চলেছে। কারণ, পাকিস্তান বাহিনী যদি লড়াইয়ে নেমে ফয়সালা করতে চায়, তবে সে ক্ষেত্রে প্রচুর প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া রেডিওর সংবাদদাতা জানান, হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আছেন তিনশরও বেশি বিদেশি এবং ৩৭৩ পাকিস্তানি কর্মকর্তা; তারা সবাই পরবর্তী ঘটনাবলির জন্য উৎকণ্ঠিত। রেডিও পিকিং থেকে প্রচারিত এক হুঁশিয়ারি দিয়ে চীন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণের জন্য ভারতকে হুমকি দেয়।

দেশের অধিকাংশ জেলা ইতোমধ্যে হানাদারমুক্ত। চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। ঢাকায় পরিকল্পিত হামলা চালিয়ে শত্রম্নদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করে। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রম্ন বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এদিন রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সম্পূর্ণ শত্রম্নমুক্ত হয়। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর সময় শহরের অদূরে যৌথ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে প্রায় এক হাজার ৫০০ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের সঙ্গে এই দিন সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী। তিনি সেখানে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি করেন। রেডিও পিকিংয়ের এক ঘোষণায় বলা হয়, ভারত যদি বিশ্বমত উপেক্ষা করে ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিত্র হিসেবে পাশে পেয়ে যা ইচ্ছা, তাই করতে পারে। তবে ভারতকে চরম শিক্ষা পেতে হবে। এদিন জানা যায়, মার্কিন সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালির পূর্বে অবস্থান করছে।

এই দিন নড়াইল মুক্ত হয়। বিকালে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। নবম বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিলস্না শহরের রেলওয়ে ক্রসিং থেকে কুমিলস্না ক্যান্টনমেন্টের দিকে অগ্রসর হয়। এ সময় মেজর আইন উদ্দিনের নেতৃত্বে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর তিনটি ট্যাংক রেলওয়ে ক্রসিং থেকে হানাদার বাহিনীর একটি দল ট্যাংকের ওপর গোলা নিক্ষেপ শুরু করে।

এদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ভৈরব সেতুর আশুগঞ্জ অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। খুলনায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি মুক্তিযোদ্ধা দল খুলনা বেতার ভবন আক্রমণ করে। এ সময় সেখানে মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল। দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পরে একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে ক্যাম্পে ফিরে যায়।

তথ্যসূত্র : রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর '৭১ এর দশমাস' ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খন্ড।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে