সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফের লাগামহীন নিত্যপণ্যের বাজার

সাখাওয়াত হোসেন
  ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

নির্বাচনের আগে নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে এ ধরনের সামগ্রী পর্যাপ্ত আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ভর্তুকি মূল্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। আলু, পেঁয়াজ, ডাল, ডিম, তেল ও চিনি আমদানিতে যাতে ডলারের সংকট না হয় সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে।

একই সঙ্গে টিসিবির পণ্য আমদানিতে ডলারের যাতে কোনো সংকট না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। এছাড়া পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা প্রশাসকদের বাজার তদারকিতে সর্বোচ্চ তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান অর্থসচিব ডক্টর মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশা, ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ নতুন আলু ও পেঁয়াজসহ শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়লে এবং আমন ধান উঠলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে যাবে। ততদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় ওপেন মার্কেট সেল অব্যাহত রাখবে। অথচ সে 'আশার গুড়ে বালি' ঢেলে নিত্যপণ্যের বাজার হঠাৎ করেই ফের তেঁতে উঠেছে।

পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, সয়াবিন তেল, চিনি, সবজি ও মাছসহ প্রায় সব ধরনের নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম গত কয়েকদিন ধরে উচ্চ লাফে বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যেসব খাবারের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ওইসব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বাজার পর্যবেক্ষক ও অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে পালস্না দিয়ে এসব পণ্যের দাম লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে।

এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে এমনিতেই স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। এর ওপর নতুন করে নিত্যপণ্যের বাজার আরও বেসামাল হলে তাদের নাভিশ্বাস উঠবে। যা ভোটের মাঠে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠায় এ নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারাও। বিশেষ করে যারা আসন্ন নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ভোটের লড়াই অংশ নিচ্ছেন তাদের আশঙ্কা, ভোটের আগে নিত্যপণ্যের দাম এভাবে হু হু করে বাড়তে থাকলে সাধারণ

ভোটাররা ভোটকেন্দ্র বিমুখ হবে। তাদের ভোটকেন্দ্রে টেনে আনা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই তারা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত যে কোনো বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকারকে তাগিদ দিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, বিষয়টি তারাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রথম কৌশল এটিকে আর বাড়তে না দেওয়া এবং তারপর তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। শুধু ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণেই দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এটা ঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, এর পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। ডলার ছাড়া অন্যান্য মুদ্রার সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনার প্রচেষ্টা চলছে।

এদিকে অর্থ সচিব খাইরুজ্জামান মজুমদার জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করেছে। এটা মেনে নেওয়া যদিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর, তবুও দেশের স্বার্থে তা মেনে নেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও বেশকিছু উদ্যোগ রয়েছে। সরকার বাজার মনিটরিংয়েও জোর দিয়েছে।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য বাজারে সিন্ডিকেশন ও ম্যানুপুলেশনকে দায়ী করেন। তিনি অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

এদিকে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার নেপথ্যে পরিকল্পনাগত নানা ত্রম্নটির বড় ভূমিকা রয়েছে দাবি করে বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যে কোনো পণ্যের চাহিদা-জোগান এবং আমদানি-রপ্তানির হিসাব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এতে নানা ধরনের ত্রম্নটি রয়ে গেছে। নিত্যপণ্য আমদানিতে একক দেশ নির্ভরতা নানা সময় বড় সর্বনাশ ডেকে আনছে। অথচ এসব বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

গত কয়েকদিনে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে ওইসব পণ্যের চাহিদা ও জোগান পর্যালোচনায় দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ দেখা যায়নি বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা দাবি করেছেন। তাদের ভাষ্য, গত কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও সম্প্রতি কোনো ধরনের ঘোষণা ঘোষণা ছাড়াই সয়াবিন তেলের দাম ৪ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ডলার সংকটে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দাম বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে আমদানিকারকরা দাবি করেছেন। তবে বিশ্ববাজারে বর্তমানে তেল যে দামে বিক্রি হচ্ছে তাতে ডলার সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার অজুহাতে দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয় বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার বাজারে বোতলজাত সয়াবিন ১৭৩ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। দুই লিটারের বোতল ৩৪৬, ৩ লিটার ৫২০ ও ৫ লিটার ৮৪৫ টাকা দরে দোকানিরা বিক্রি করছেন। অথচ গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমানো হয়। এর পর থেকে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৯, পাঁচ লিটার ৮২৫ এবং খোলা পামঅয়েল ১২৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল।

এদিকে চিনির বাজারও বেশকিছু দিন ধরে অস্থিতিশীল। প্যাকেট চিনির ব্যাপক সংকট রয়েছে। খোলা চিনি ১৪৫-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার চিনির দাম নির্ধারণ করে দিলেও আমদানিকারক ও আড়তদাররা তোয়াক্কা করছে না। তারা ইচ্ছেমতো চিনির দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। চিনির বাজার চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক কয়েকটি সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে। সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে চিনির বাজার অশান্ত করে তুলছে। তারা বাজার থেকে মোড়কজাত চিনি উধাও করে দিয়েছে। ফলে ভোক্তারা বিপাকে পড়েছেন।

সম্প্রতি পেঁয়াজের হাইজাম্পের নেপথ্যেও সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন বাজার পর্যবেক্ষকরা। তারা জানান, সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ভারত ও দেশের স্থলবন্দরের বিভিন্ন আমদানিকারকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখেন। মোবাইল ফোনেই চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়। ২৮ অক্টোবর ভারত সরকার পেঁয়াজের দাম প্রতি টন ৮০০ ডলার নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বাড়তি দামের সেই পেঁয়াজ আমদানির আগেই চট্টগ্রামে দাম বাড়িয়ে দেন আমদানিকারকরা। অতি সম্প্রতি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

কৃষিবিদরা জানান, পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ দেশে উৎপাদিত হলেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় এর ২০ থেকে ২২ শতাংশ পচে যায়। ঘাটতি এই ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। যার সিংহভাগে আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। ফলে সে দেশে কোনো কারণে পেঁয়াজের সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশের ভোক্তাদের বড় ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। গত পাঁচ বছরে অন্তত ১০ দফা এ সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

অথচ পেঁয়াজ আমদানিতে ভারতের একক নির্ভরতা কমাতে দীর্ঘদিনেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এছাড়া পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন এবং উৎপাদিত পেঁয়াজ পচে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উন্নত সংরক্ষণাগার তৈরির পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। যা গড় মৌসুমে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ছাড়া, বাজারে মসলাজাতীয় পণ্যের দামও বাড়তির দিকে। মানভেদে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৬০ টাকা যা সপ্তাহ খানেক আগে বিক্রি হয়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। গত বছরের এ সময় জিরার কেজি ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত সপ্তাহে লবঙ্গের কেজি ছিল ১৪শ' থেকে ১৫শ' টাকা।

অন্যদিকে বাজারে শীতের সবজি এলেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। মাছের দামও এখনো নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালে আসেনি। ব্রয়লার মুরগির দাম উচ্চমূল্যে থমকে আছে। সম্প্রতি গরুর মাংসের দাম কিছুটা কমে ৫৯০ থেকে ৬০০ টাকায় এসে ঠেকলেও তা ফের ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। ভোক্তাদের অভিযোগ, ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান 'ভোক্তা অধিদপ্তরের' অযাচিত হস্তক্ষেপেই গরুর মাংসের দাম বেড়েছে। আগামীতে এর দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে