সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভা হয় যশোর টাউন হল ময়দানে

বীরেন মুখার্জী
  ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

একাত্তর সালের ১১ ডিসেম্বর যশোর টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। তারা চারটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এক. বাংলাদেশ সরকার ওয়ার ট্রাইবু্যনাল গঠন করছেন। নরহত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে যুদ্ধবন্দিদের বিচার করা হবে। দুই. ২৫ মার্চের আগে যিনি জমি, দোকানের মালিক ছিলেন তাকে সব ফিরিয়ে দিতে হবে। তিন. সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। চার. চারটি রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামী ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

এই দিন মুক্তি ও মিত্রবাহিনী কুষ্টিয়া, জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়িহাট, বাহাদুরাবাদ ঘাট, পিসপাড়া, দুর্গাদীঘি, বিলগ্রাম, চন্ডীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা হানাদারমুক্ত করে।

মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত জনগণের উদ্দেশে এক নির্দেশনায় বলা হয়, 'ওই খুনিগুলোকে (ধরা পড়া বা সারেন্ডার করা পাকিস্তানি সৈন্য) তোমরা মেরে ফেল না, মুক্তিবাহিনীর হাতে ওদের হস্তান্তর করো। হয়তো ওদের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতাকে উদ্ধার করতে পারব।'

এই দিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিলে বাংলাদেশ ইসু্যতে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে আবারও উত্তেজনা দেখা দেয়। বিশ্ববাসী বুঝতে পারে বাংলাদেশের অভু্যদয় এখন সময়ের ব্যাপার।

বাংলাদেশের যুদ্ধ প্রশ্নে জাতিসংঘে নতুন নাটকীয়তার আশ্রয় নেয় পাকিস্তান। বিদেশি নাগরিকদের নিরাপদে ঢাকা ত্যাগের সুযোগ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ অনুরোধে যৌথবাহিনী সকালে ঢাকায় সাময়িকভাবে বিমান হামলা বন্ধ রাখে। এই সুবাদে ঢাকায় পাকিস্তানের দালাল বাঙালি গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালেব

মালিক পাকিস্তানি সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির মাধ্যমে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পাঠানো এক বার্তায় পাকিস্তানি সৈন্য ও বেসামরিক ব্যক্তিদের পাকিস্তানে সরিয়ে নিতে সাহায্য কামনা করেন।

পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগাশাহী ফরমান আলির এ বার্তা জাতিসংঘকে অগ্রাহ্য করার আবেদন জানান। একই দিন জেনারেল নিয়াজির কাছে পাঠানো একান্ত বার্তায় ইয়াহিয়া জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর খুব শিগগিরই সাহায্যে এগিয়ে আসবে। অন্যদিকে চীনা সৈন্যরা নেফা সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সমগ্র টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত হয়। কাদের সিদ্দিকীর 'কাদেরিয়া বাহিনী' ১৯ এপ্রিল থেকে এই অঞ্চলে শতাধিকবার পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে আসছিল ও অনেক দুঃসাহসী অপারেশন চালায়।

মুজিবনগর সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, মুক্তাঞ্চলের জনগণ ধরা পড়া হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে 'জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্স্নোগান দিয়ে হস্তান্তর শুরু করেন। মিত্রবাহিনীর মুখপাত্র এদিন গণমাধ্যমকে জানান, পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় জামালপুরে ৬০০, লাকসামে ৪০০ এবং মেঘনার পূর্বপাড়ে বিভিন্ন স্থানে ৮০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।

পাকিস্তানি বাহিনীও শেষ মুহূর্তের লড়াইয়ে সম্মিলিত বাহিনীর গতিরোধ করার জন্য এদিন পদ্মা নদীর ওপরে রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কয়েকটি স্প্যান উড়িয়ে দেয়। ঢাকায় বিকাল ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে ঢাকা থেকে ব্রিটিশ ও অন্যান্য বিদেশি নাগরিক সরিয়ে নেওয়া হয়।

এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিতে জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লন্ডনে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। হিথরো বিমানবন্দরে তিনি বলেন, 'যুদ্ধবিরতির কথা অবাস্তব। জাতিসংঘকে তিনি জানাবেন, বর্তমানে এটা গ্রহণের অযোগ্য। বাংলাদেশ পরিস্থিতির মূল সমস্যা যতক্ষণ না মিটছে এবং বাংলাদেশের যুদ্ধবিরতির আলোচনায় যতক্ষণ না বাংলাদেশকে ডাকা হচ্ছে, ততক্ষণ যুদ্ধবিরতি অবাস্তব বলে মনে হয়।'

যুক্তরাষ্ট্রে সোভিয়েত প্রতিনিধিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সাবধান করে দিয়ে বলেন, 'আগামীকাল ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করানো হবে। না হলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা নেবে।' যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইসু্যতে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ফের উত্তেজনা দেখা দেয়।

তথ্যসূত্র: '৭১-এর দশমাস', রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খন্ড।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে