শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ কেনাকাটায় আগুনের আঁচ!

ঈদ বাজেটে বড় কাটছাঁট পোশাকে দাম বেড়েছে ৩০-৩৫ শতাংশ
সাখাওয়াত হোসেন
  ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রাজধানীর মার্কেটগুলোতে বাড়ছে ক্রেতাদের ভিড়। ছবিটি রোববার আজিজ সুপার মার্কেট থেকে তোলা -যাযাদি

বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান মিলিয়ে সাত সদস্যের সংসার ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন বায়িং হাউজের সহকারী হিসাব রক্ষক রাশেদুল হাসানের। মধ্যম আয়ের এই কর্মকর্তা প্রতিবছর ঈদে সবার জন্য নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ কিনলেও এবার সে তালিকায় কাঁচি চালাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তারপরও ঈদ কেনাকাটার তালিকায় থাকা পরিবারের সদস্যদের জন্য পছন্দ অনুযায়ী সব কিছু কিনতে পারবেন কিনা তা নিয়েও রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।

একই অবস্থা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা এনজিও কর্মকর্তা মিলস্নাত হোসেনেরও। প্রতি বছর ঈদুল ফিতরে গ্রামে থাকা দুই ভাই-বোনের জামা-জুতার সঙ্গে বাবা-মায়ের জন্য পাঞ্জাবি-শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরতেন তিনি। তবে এবার নিজের ছেলে-মেয়ের ঈদের পোশাক কেনার পর বাড়তি কেনাকাটার পর্যাপ্ত টাকা হাতে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তিনি। তাই শেষ পর্যন্ত ঈদ কেনাকাটার তালিকা থেকে বৃদ্ধ মা-বাবাকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু রাশেদুল হাসান কিংবা মিলস্নাত হোসেনই নয়, তাদের মতো মধ্যবিত্ত লাখ লাখ পরিবার এবার তাদের ঈদ কেনাকাটার পুরানো তালিকা অর্ধেকই ছেঁটে ফেলেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্পআয়ের মানুষ। এর ওপর ঈদের জামা-কাপড়, জুতা, ব্যাগ ও প্রসাধনীসহ উৎসব কেন্দ্রিক সব ধরনের পণ্যের বাজারের আগুনের আঁচ লেগেছে। ফলে নিম্ন-মধ্যবিত্তরা পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদ কেনাকাটা করতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়ছেন। গোটা পরিবারের ঈদ বাজেটে আধা কেনাকাটা করাও অনেকের পক্ষে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় বেশিরভাগ বাবা-মা নিজের শখ-শৌখিনতা বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র পরিবারের শিশু সন্তানদের জন্য ঈদের পোশাক-পরিচ্ছদ কিনছেন। চাহিদার সঙ্গে আর্থিক সঙ্গতির সামাল দিতে গিয়ে ঈদ উৎসবের খাবারের তালিকাও অনেকে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন।

বাজার বিশ্লেষকরা জানান, খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য দীর্ঘদিন ধরে আকাশ ছোঁয়া। অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন মূল্যস্ফীতির নেপথ্য কারিগর বাজার সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বরং তাদের হাতে জিম্মি থাকার কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বীকার করে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে। এ সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা ঈদ উৎসব কেন্দ্রিক পোশাক-পরিচ্ছদের দাম খেয়াল-খুশিমতো বাড়িয়েছে। এবারের ঈদবাজারে উৎসবকেন্দ্রিক পোশাকের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এতে নিম্নমধ্যবিত্ত অনেকের ঈদের পোশাক কেনার

ক্ষমতা হারিয়েছে।

তবে ব্যবসায়ী নেতাদের ভাষ্য, কাঁচামালের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে পণ্য উৎপাদনে। এছাড়া ডলার সংকট ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি খরচও দেড় থেকে দুইগুণ বেড়েছে। ফলে ঈদের পোশাকসহ উৎসবকেন্দ্রিক বেশিরভাগ জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে হয়েছে। এতে ঈদবাজারে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে।

তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, পোশাক-পরিচ্ছদসহ ঈদ উৎসব কেন্দ্রিক বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা নানা অযুহাত দেখালেও এর নেপথ্যে রয়েছে মূলত তাদের অতিমুনাফা লোভী প্রবণতা। নগরজুড়ে তীব্র যানজটের কারণে ক্রেতারা একাধিকবার মার্কেটে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় বিক্রেতারা এর সুযোগ নিচ্ছে।

জাহানারা বেগম নামের একজন গৃহিণী বলেন, 'গাউছিয়া মার্কেট সবসময় 'রিজনেবল প্রাইজে' জিনিসপত্র বিক্রি হলেও এবারের ঈদে বিক্রেতারা যেন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। শাড়ি-থ্রিপিস সব কিছুরই আকাশছোঁয়া দাম হাঁকছে। বাচ্চাদের এক দেড় হাজার টাকার পোশাক দুই হাজার টাকার নিচে কেনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুব্ধ এ গৃহিণী জানান, জিনিসপত্রের গলাকাটা দাম শুনে তিনি শুধু দুই শিশু সন্তানের ঈদের পোশাক কিনে বাড়ি ফিরছেন। ঈদের পর বাজার স্বাভাবিক হলে পরিবারের বাকিদের ড্রেস কিনবেন।

একই ধরনের অভিযোগ তুলে ইসমত আরা নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী বলেন, ঈদ সামনে রেখে সব সময়ই জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বাড়ে। কিন্তু এবার যেভাবে বেড়েছে, তা কল্পনাতীত। তার ভাষ্য, নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির দাপটে এমনিতেই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। এর উপর দোকানিরা যেভাবে ঈদ উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদের গলাকাটা দাম হাঁকছে, তাতে অনেকের এবার ঈদের পোশাক কেনা হবে না।' ভোক্তা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা অনেকটাই দায়সারা বলে মনে করেন এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।

এদিকে শুধু মার্কেট, শপিংমল ও বিপণি-বিতানেই নয়, চড়া মূল্যের উত্তাপ যেন ছড়িয়েছে ফুটপাতেও। নিউ মার্কেট-গাউছিয়া এলাকা থেকে শুরু করে, রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, জিরো পয়েন্ট, গোলাপশাহ মাজার মোড়, বায়তুল মোকাররম, মতিঝিল, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, শান্তিনগর, রামপুরা, খিলগাঁও, মুগদা, বাসাবো, এলিফেন্ট রোড, মৌচাক, মালিবাগ, মিরপুর এলাকাসহ বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটে লাগোয়া ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসা দোকানগুলো ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।

এদিকে মূল্য ছাড়ের নামে ঈদ বাজারে চলছে হরেক রকম প্রতারণা। কোনো কোনো দোকানি পাঞ্জাবি-শার্ট, থ্রিপিস, শাড়িসহ বিভিন্ন পণ্যে স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে দুই-তিনগুণ বেশি দামের স্টিকার লাগিয়ে তার উপর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা দিচ্ছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানে গত কয়েকদিনে এ ধরনের প্রতারণার বিপুল সংখ্যক ঘটনা ধরা পড়েছে। অভিযুক্ত দোকানিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও মূল্য ছাড়ের প্রতারণা চলমান রয়েছে। এছাড়া ঈদবাজারে দেশীয় পণ্য বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দাবি করে চড়া দাম হাঁকা হচ্ছে। ক্রেতারা জানান, মিরপুর বেনারসি পলিস্নতে দেশে তৈরি এক দেড় হাজার টাকার কাতান শাড়ি ভারতীয় বলে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কোনো কোনো দোকানি নিম্নমানের এসব শাড়ি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে বছর জুড়েই চলে এ ধরনের প্রতারণা। তবে ঈদকে সামনে রেখে এ প্রতারণায় নতুন গতি পেয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শাড়ির দোকানে কোনো ক্রয় রশিদ নেই। ক্রেতাদের বিক্রি রশিদ দেওয়া হচ্ছে না। শাড়িতে দেওয়া স্টিকারে এস এল নম্বর ও কোড দেওয়া থাকলেও মূল্য দেওয়া থাকছে না। ব্যবসায়ীরা এসএল অনুযায়ী বালাম বইয়ে ইচ্ছেমতো ক্রয়মূল্য লিখে রাখছে।

ক্রেতারা জানান, ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, উৎসব কেন্দ্রিক সব পণ্যের দাম ততই যেন বাড়ছে। তাই অনেকে কিছুটা তাড়াহুড়ো করে ঈদ শপিং এখনই সেরে ফেলতে চাইছে। তবে যতটা আশা নিয়ে রাজধানীর মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তরা বিভিন্ন মার্কেটে ঢুঁ মারছেন, ততটা হতাশা নিয়েই ঘরে ফিরছেন। কারণ পোশাকের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ক্রেতাদের অভিযোগ, যে পোশাক রোজার আগে দাম ছিল দুই হাজার টাকা, সে পোশাকই এখন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে।

এছাড়া মার্কেট ভেদে একই পোশাকের দামে আকাশ-পাতাল ফারাক। ক্রেতারা জানান, যে থ্রিপিসের দাম মৌচাক মার্কেটে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা, সেই একই পোশাক বসুন্ধরা শপিংমলে দাম হাঁকছে চার হাজার টাকা। এছাড়া নামকরা ফ্যাসন হাউজগুলোতে যে মানের পোশাকের দাম ৫ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে, একই মানের পোশাক মাঝারিমানের মার্কেটগুলোতে মিলছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়।

অন্যদিকে অনলাইনেও একই পণ্য আকাশ-পাতাল দরে বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো চড়া দরে ঈদের পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। তবে প্রতারিত হওয়ার ভয়ে বেশিরভাগ ক্রেতা সেখান থেকেই পণ্য কিনছেন।

ক্রেতাদের ভাষ্য, সরকারের নজরদারি না থাকার সুযোগে ঈদবাজারে জিনিসপত্রের দাম যেমনি আকাশ ছুঁয়েছে। তেমনি অনলাইন বিক্রেতাদের প্রতারণার ফাঁদও বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষ করে ঈদকে সামনে রেখে এচক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অনলাইনে দামি থ্রিপিসের অর্ডার নিয়ে সাধারণ মানের আন-স্টিচ কাপড় পাঠিয়ে দেওয়ার অনেক ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি এ প্রতারক চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করলেও তারা থেমে নেই বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

ঈদ পণ্য মূল্যের পাগলা ঘোড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং জরুরি দাবি করে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজা-ঈদসহ কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান এলে দেশে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। তাই ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হলে সংশ্লিষ্টদের কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে। ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে