সরকারের নানা উদ্যোগের পরও গ্যাস ও বিদু্যতের সংকট এখনো কাটেনি। বরং কিছু ক্ষেত্রে তা প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে জ্বালানি সংকটের কারণে বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রে বিদু্যৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রোজার শুরুতেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে পালস্না দিয়ে বিদু্যতের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী হওয়া মাত্রই লোডশেডিং বাড়তে শুরু করবে। এ সময় গ্যাস সংকটও রোজাদারদের চরম ভোগাবে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
তাদের আশঙ্কা, রোজার দিন যত পার হতে থাকবে, গরমের প্রভাবে গ্যাস ও বিদু্যৎ সংকটও ততই বাড়বে। এ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে গার্মেন্টসসহ সব ধরনের শিল্পকারখানার উৎপাদনেও ভয়াবহ ধস নামতে পারে। যা দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৩৫টি কেন্দ্রের বিদু্যৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট হলেও গত ২১ ফেব্রম্নয়ারি পিক-আওয়ারে এই বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোতে মাত্র ১ হাজার ৬৩১ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদিত হয়েছে। গ্যাস সংকটে ৪টি ও তরল জ্বালানি সংকটে ৩টি বিদু্যৎকেন্দ্রের উৎপাদন বিপর্যয় ঘটে। এছাড়া, মেইনটেনেন্স ও চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণের কারণে ৬টিসহ মোট ২২টি বিদু্যৎকেন্দ্র উৎপাদনশূন্য দিন পার করেছে।
একইদিন চট্টগ্রাম এলাকার ২২টি বিদু্যৎকেন্দ্রের মধ্য ১২টিতে এক মেগাওয়াট বিদু্যতও উৎপাদিত হয়নি। মেইনটেনেন্স, মেশিন সমস্যা, তরল জ্বালানি সংকটে ৪ হাজার ৯১৫ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদনে সক্ষম এই বিদু্যৎকেন্দ্রগুলোতে মাত্র ২ হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট বিদু্যৎ পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, ২ হাজার ৮৯৭ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষম কুমিলস্না এলাকার ১৯টি কেন্দ্রে ২১ ফেব্রম্নয়ারি পিকআওয়ারে মাত্র ১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন হয়েছে। এদিন সেখানকার ৫টি বিদু্যৎকেন্দ্রে উৎপাদন ছিল শূন্য মেগাওয়াট। গ্যাস ও তরল জ্বালানি সংকট, মেইনটেনেন্স ও চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণের কারণে বিদু্যৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনে এই বিপর্যয় ঘটে।
ময়মনসিংহের ৮টি বিদু্যৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৭৪৯ মেগাওয়াট হলেও এদিন উৎপাদিত হয়েছে ১৮১ মেগাওয়াট। এছাড়াও সিলেটের ১৫টি, খুলনার ১০টি, বরিশালের ৮টি, রাজশাহীর ১৭টি বিদু্যৎ ও রংপুর এলাকার ৯টি উৎপাদন কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা যথাক্রমে ২ হাজার ৩৬৮ মেগাওয়াট, ৩ হাজার ৬৮৬ মেগাওয়াট, ২ হাজার ২৬৫ মেগাওয়াট, ৩ হাজার ৩৯৩ মেগাওয়াট ও ৯৫০ মেগাওয়াট। তবে, এসব কেন্দ্রগুলোতে পিকআওয়ারে বিদু্যৎ উৎপাদিত হয়েছে যথাক্রমে ৯৫৮, ১ হাজার ৮০, ১ হাজার ৩৯৮, ১ হাজার ৬৬১ ও ১৭৩ মেগাওয়াট।
এ হিসাবে ২১ ফেব্রম্নয়ারি সারাদেশের মোট ১৪৩টি বিদু্যৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ১৫০ মেগাওয়াট হলেও গ্যাস ও তরল জ্বালানি সংকট, মেইনটেনেন্স এবং চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে বিদু্যৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১০ হাজার ৫৮০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ বিদু্যৎ উৎপাদিত হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যখন গ্যাস-বিদু্যতের সংকট বিশেষ কোনো খাতে থাকে, অন্য খাতে সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে তা সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু সংকট সব খাতে বিস্তৃত থাকলে তা সামাল দেওয়া কঠিন। দীর্ঘদিন ধরে দেশে গ্যাসের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে, এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে বাড়ানোর কৌশল নিয়েছিল সরকার। বর্তমানে পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে কোনো হিসাব-নিকাশই মিলছে না।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। পবিত্র রমজান মাসে এটি বেড়ে ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট হতে পারে। শীতের মৌসুমে বাসাবাড়ি ও দাপ্তরিক কাজে বিদু্যতের চাহিদা তুলনামূলক কম থাকায় শিল্প খাতে সরবরাহ কিছুটা বাড়ানো গিয়েছিল। কিন্তু গরম শুরু হতেই বাসাবাড়ি ও সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে বিদু্যতের চাহিদা বাড়ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে গ্যাস-বিদু্যৎ সংকট সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শিল্প মালিকদের মারাত্মকভাবে ভোগাবে।
একই আশঙ্কা প্রকাশ করে নগরবাসী বলছে, বিগত সময়ের মতো এ বছরও শীতের পুরো সময়টা বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংকট ছিল। অনেক এলাকায় দিনের বেলা গ্যাস পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ গৃহিণীকে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে হয়। এ পরিস্থিতিতে রোজার শুরুতেই গ্যাস ও বিদু্যতের সংকট নিশ্চিত ভোগান্তি বাড়াবে।
জ্বালানি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের স্বল্প মেয়াদে জ্বালানি খাতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের জ্বালানি নীতি বাতিল করলেও চুক্তিগুলো বহাল রেখেছে। গ্যাস-বিদু্যৎ নিয়ে অতীত সরকারের ভুল নীতি থেকে বেরিয়ে এসে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। গ্যাস ও বিদু্যতের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং এর অপচয় রোধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়ারও পরামর্শ দেন তারা।
এদিকে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এসি না চালানোর যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তাদের ভাষ্য, বিগত সময়েও বহুবার এ ধরনের 'টোটকা' উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। বিদু্যতের ঘনঘন লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি থেকে দেশের জনগণের রেহাই মেলেনি।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে মোটামুটি চাহিদা মেটানো যায়। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। রমজান মাসে এটি বেড়ে ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট হতে পারে। যা সামাল দেওয়া কতটা সম্ভব তা নিয়ে তারা নিজেরাই সন্দিহান।
তিতাস গ্যাসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর তেমন সুযোগ নেই। প্রতিদিন গড়ে ১৯৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের চাহিদা দিয়েছে তিতাস। প্রকৃত চাহিদা আরও বেশি। এখন তারা সরবরাহ পাচ্ছে ১৫৫ কোটি ঘনফুট। রমজান মাসে তাদের সরবরাহ বাড়িয়ে ১৭০ কোটি ঘনফুট করা হতে পারে। তবে বাড়তি গ্যাসের পুরোটাই যাবে বিদু্যৎ উৎপাদন খাতে। ফলে, রমজানে আবাসিকে গ্যাস সংকট কিছুটা বাড়বেই। কেননা, রোজার দিনগুলোতে আবাসিকে গ্যাসের চাহিদা বেশ খানিকটা বৃদ্ধি পায়।
জ্বালানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বিদু্যতের বকেয়া বিলের পরিমাণ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে খুব বেশি কমেনি। বিল না পাওয়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা প্রাথমিক জ্বালানি ফার্নেস অয়েল ও কয়লা আমদানিতে হোঁচট খাচ্ছে। অর্থ সংকটে রয়েছে গ্যাস খাতও। বকেয়া ও ডলার সংকটে এলএনজি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। দেশীয় উৎস থেকেও গ্যাসের জোগান কমছে। ফলে, রমজানের শুরু থেকেই তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী বিদু্যৎ উৎপাদন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বিদু্যতের প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এর মধ্যে ৫৮টি গ্যাসচালিত বিদু্যৎকেন্দ্রের সক্ষমতা উৎপাদনের ৪৪ শতাংশ তথা ১২ হাজার মেগাওয়াট। সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ২৬ শতাংশ তথা ৭ হাজার মেগাওয়াট সরবরাহ করে। ফার্নেস অয়েল থেকে পাওয়া যাবে সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট। ভারত থেকে আমদানি করা হয় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এছাড়া, সৌর-জলবায়ু থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদু্যৎ আসে। অথচ বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ১০ থেকে সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট। তবে, রমজানের শুরু থেকে বিদু্যতের চাহিদা ধাপে ধাপে বেড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১৮ হাজার মেগাওয়াটে ওঠানামা করবে। এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ৫ হাজার ৫৫৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪ হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট এবং বিদু্যৎ আমদানি করে ২ হাজার ১২৫ মেগাওয়াট বিদু্যৎ পাওয়া যাবে, যদি চাহিদা অনুসারে জ্বালানি মেলে। কিন্তু বাস্তবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের সম্ভাবনা কম।
এদিকে রমজানের শুরুতেই যে লোডশেডিং ভোগান্তি বাড়বে তার আলামত এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এক দেড় ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। তবে, শহরের তুলনায় গ্রামে এরই মধ্যে লোডশেডিং কয়েক গুণ বেড়েছে। কোথাও কোথাও ৩/৪ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় ধরে বিদু্যৎ থাকছে না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে।
পিডিবির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রোজার মাসে কয়লাভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে, এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। কয়লা থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট। অথচ উৎপাদিত হচ্ছে তিন হাজার মেগাওয়াটের কম। কারিগরি ত্রম্নটি, বকেয়া বিদু্যৎ বিল, ডলারের সংকট ও কয়লা আমদানির জটিলতায় সরবরাহ ধরে রাখতে পারছে না বিদু্যৎকেন্দ্রগুলো।
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদু্যৎকেন্দ্রে তিনটি ইউনিট মিলে সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এটি নিজস্ব খনির কয়লা দিয়ে চলে। কয়লার অভাবে দুটি ইউনিট অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। বর্তমানে একটি ইউনিট থেকে উৎপাদিত হচ্ছে ১০০ মেগাওয়াটের কম। এর বাইরে আদানিসহ সাতটি বিদু্যৎকেন্দ্র পরিচালিত হয় আমদানি করা কয়লা থেকে। এ পরিস্থিতিতে রমজানের শুরু থেকেই তাপমাত্রার সঙ্গে পালস্না দিয়ে বিদু্যতের চাহিদা বাড়তে থাকলে তা সামাল দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।