বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২
বিএনপির বর্ধিত সভা

ক্ষোভ অভিমানের পাশাপাশি একগুচ্ছ দাবি তৃণমূলের

দলের সুবিধাভোগী নেতাকর্মীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সুনাম নষ্টকারীদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে পদ-পদবি আর মনোনয়নে ত্যাগীদের মূল্যায়নের তাগিদ কোন্দল নিরসনে উদ্যোগ নিতে হবে
বিশেষ প্রতিনিধি
  ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ক্ষোভ অভিমানের পাশাপাশি একগুচ্ছ দাবি তৃণমূলের
ক্ষোভ অভিমানের পাশাপাশি একগুচ্ছ দাবি তৃণমূলের

দীর্ঘদিন পরে দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে বিএনপির তৃণমূলের নেতারা ক্ষোভ অভিমান প্রকাশের পাশাপাশি একগুচ্ছ দাবি জানিয়েছেন। দলের বিরুদ্ধে ও নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র হচ্ছে; এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য ধরে রাখার কথা বলেছেন তারা। তাদের মতে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানে ফ্যাসিবাদ সরকার পালিয়ে গেলেও এখনো তার দোসররা রয়েগেছে। বিএনপিকে নিয়ে তারা নানাবিধ চক্রান্ত করছে। এই চক্রান্ত মোকাবিলায় নিজেদের যেমন সজাগ থাকতে হবে তেমনি জনগণের দোড়গোড়ায় যেতে হবে। নিজেদের গুটিকয়েক নেতাকর্মীর অপকর্মকে রোধ করতে হবে। ওই কয়েকজনের দায়ভার পুরো দল নিতে পারে না। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে শুধু সাংগঠনিক ব্যবস্থা নয়, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রায় সাত বছর পর বৃহস্পতিবার বিএনপির বর্ধিত সভায় সারাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন জেলা, মহানগর ও থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের কাছে এ আহ্বান জানিয়েছেন। সকাল ১১টায় 'সুদৃঢ় ঐক্য রুখে দিতে পারে সব ষড়যন্ত্র' স্স্নোগান নিয়ে সংসদ ভবনের এলডি হলের মাঠে বিএনপির এই বর্ধিত সভা হয়। সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, লন্ডন থেকে তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। প্রধান অতিথি হিসেবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে ভাচুর্য়ালি যুক্ত হয়ে এই সভায় বক্তব্য রাখেন। এর আগে, তারেক রহমান ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন। সারাদেশের তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের প্রায় সাড়ে তিন হাজার নেতা এই বর্ধিত সভায় অংশ নেন। সভার শুরুতে বিগত ১৬ বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহত এবং দলের প্রয়াত নেতাকর্মীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

পরে সারাদেশ থেকে আগত নেতাকর্মীদের বক্তব্যের পালা শুরু হয়। এসব নেতার বক্তব্যে বেশিরভাগেই হাইব্রিড নেতাকর্মীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাওয়া, কমিটিতে সেসব নেতাদের গুরুত্ব পাওয়া, বিভিনন্ন স্থানে দলের নাম ব্যবহার করে কতিপয় নেতাকর্মীদের দলের আদর্শবিরোধী অনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হওয়া, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে এলাকায় কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগ ছাড়াও বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর ষড়যন্ত্র বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি যেমন ছিল তেমনি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতাও করা হয় কোনো কোনো নেতার বক্তব্যে। কোনো কোনো নেতার বক্তব্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসরদের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের কোনো কোনো নেতার আতাতের অভিযোগও উঠে আসে।

অনুষ্ঠানে পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুন নাহার খানম বলেন, চিরস্থায়ীভাবে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখতে এখনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে বর্ধিত সভা নয়, বিভাগীয় পর্যায়ের সম্মেলন করতে হবে। সেখানে তৃণমূলের কষ্টের কথা জানতে হবে। সেটার প্রতিকার করতে হবে। দলকে পুরোপুরিভাবে জনমুখী করতে হবে। তিনি বলেন, সারাদেশে বিএনপি কার্যালয়ভিত্তিক রাজনীতি করলেও এখন তাদের প্রতিপক্ষ একটি দল (জামায়াত) মসজিদভিত্তিক রাজনীতি করছে। এই মসজিদভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকবে কিনা তা এই অন্তর্বর্তী সরকারকে ভেবে দেখতে হবে। প্রতিপক্ষ ও দলটি বিএনপির বিরুদ্ধে অনেক গুজব, অপপ্রচার করছে। সেটার জন্য দলকে কাউন্টার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিতে বিগত দিনে যারা সক্রিয় ছিলেন না, আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের বিষয়ে দল থেকে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। যদি এসব নেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়োর নেতা হুমায়ুন কবির বলেন, জামায়াতকে মোকাবিলায় সকালে মসজিদে নামাজ পড়তে হবে। দলকে এগিয়ে নিতে হলে ত্যাগীরা পিছিয়ে থাকবে না, মৌসুমি নেতারা এগিয়ে যাবে না- এমন কৌশলে এগোতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে সরকারের গঠিত কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে তার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ইউপি মেম্বারদের ভোটে চেয়ারম্যান নয়, জনগণের ভোটে চেয়ারম্যান না হলে জনগণের কাছে ওইসব জনপ্রতিনিধি দায়ভার নেবে না। অন্যদিকে, জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে তিনি জানান। খুলনা সদর থানা বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, একটি গুপ্ত সংগঠন সারাদেশে মব সৃষ্টি করছে, অরাজকতা করছে, বিএনপিকে নিয়ে গুজব সৃষ্টি করছে। এই দলটি বিগত ১৬ বছর বিএনপির সঙ্গে থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন করলেও এখন তারা সুবিধাজনক সময়ে আওয়ামী লীগের দোসরদের প্রতিষ্ঠা করছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আঁতাত করছে।

সভায় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়। নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণারও দাবি জানানো হয়। সবাই ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন চান।

টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকার নেতা জাকির হোসেন সরকার বলেন, শেখ হাসিনা যদি বিএনপিকে ধ্বংসই করতে পারত তাহলে আজ বিজয় আসত না। বিগত দিনে যে আওয়ামী লীগ এত অত্যাচার করেছে এখন সেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দলের কতিপয় নেতাকর্মী প্রশ্রয় দিচ্ছেন, মদত দিচ্ছেন। যারা গত ১৫ বছর ছিল না তারা এখন আমাদের ঘরে ঢুকে ঐক্য বিনষ্ট করতে চাচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এদের থামাতে হবে। আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে একেবারে তৃণমূলে কোন্দল বাড়ছে। দল বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এটা যাতে সামনে না বাড়ে এজন্য দলের হাইকমান্ড থেকে এখনি সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। বিগত দিনের সুবিধাভোগীরা যাতে মনোনয়ন না পায় সেটা হাইকমান্ডকে নিশ্চিয়তা দিতে হবে।

নওগার মহাদেবপুর এলাকার নেতা রবিউল আলম বলেন, ৫ আগস্টের পর এখন অনেক নেতাকর্মী দেখা যাচ্ছে। যাদের বিগত আন্দোলনে দেখা যায়নি। সুবিধাভোগী নেতাকর্মীদের ভিড় দেখে মনে হচ্ছে- আমরাই এখন দলে সংখ্যালঘু।

হবিগঞ্জের সিরাজুল ইসলাম বলেন, বিগত দিনে যারা গর্তে লুকিয়ে ছিল, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আতাত করেছিল তাদের এখন আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। এই সুবিধাভোগীদের কাছে ত্যাগীরা হারিয়ে গেলে পুরো বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দলের দুর্দিনে তৃণমূল বেইমানি করেনি। যে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। অথচ এক শ্রেণির মৌসুমি নেতা সুবিধা নিয়ে মোটাতাজা হয়েছে। আর ত্যাগীরা হয়েছেন স্বাস্থ্যহীন। এই ত্যাগীরা দলের হাইকমান্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।

সৈয়দপুর জেলা বিএনপি নেতা আলমগীর মাতুব্বর বলেন, যারা আমাদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে। তারাই আজ বিএনপির প্রথম কাতারে। এই হাইব্রিড যেন বিএনপি না ঢুকে।

জামালপুর জেলা বিএনপি নেতা আতিকুর রহমান সাজু বলেন, জুলাই-আগস্টে যারা আন্দোলন করেছে তারা আমাদেরই সন্তান। তারা আওয়ামী লীগের দোসরদের কেউ নয়। তাই ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফিরে যাওয়া উচিত। আর দেশে এখন ষড়যন্ত্র চলছে। এজন্য বিএনপির কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠনকে চাঙ্গা করতে হবে। যেসব জায়গায় অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি নেই, সেসব জায়গায় কমিটি দিতে হবে। যেসব জায়গায় বিএনপির কমিটি নেই, সেসব জায়গায় বিএনপির কমিটি দিতে হবে।

জামালপুর জেলা বিএনপি নেতা জহিরুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ৫ আগস্টের সপর নব্য বিএনপি হয়েছে। তাদের জন্যই বিএনপির এই বেহাল দশা। আর মসজিদ ও মাদ্রাসার কমিটি নিয়ে ঝগড়া হয়, এগুলো থেকে সরে আসতে হবে।

ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি নেতা জিয়াউল ইসলাম জিয়া বলেন, দেশে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে। সুতরাং, আপনি (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান) নিজস্ব সেল ও জরিপের মাধ্যমে মনোনয়ন দেবেন। তাকেই মনোনয়ন দেবেন যারা অবস্থান সবচেয়ে ভালো হবে। আর যারা দলের ক্ষতি করবে গোপন সেল করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।

ভোলা জেলা বিএনপি নেতা মফিজুর রহমান মিলন বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না। বিএনপিতে আওয়ামী লীগের দোসরদের জায়গা যাতে না হয়।

যশোর জেলা বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, প্রত্যেক জায়গায় হাইব্রিড ও গ্রম্নপিং রয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে গ্রম্নপিং দূর করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিতে হবে।

দিনাজপুর জেলা বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম মিলন বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলকে শক্তিশালী করতে হবে। ৫ আগস্টের পরে বিএনপির ভেতরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। ত্যাগীদের কোণঠাসা ও বহিষ্কার করা হচ্ছে। পদ স্থগিত করা হচ্ছে। তাদের পদ ফিরিয়ে দিতে হবে। তৃণমূলকে জাগাতে হবে, হাইব্রিডদের ঠেকাতে হবে।

নোয়াখালী জেলা বিএনপির নেতা দেওয়ান শামসুল আরেফিন শামীম বলেন, বিগত ১৭ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামে যাদের ডেকে পাইনি, তাদের দলে দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তাদের দায়িত্ব দিলে আগামীতে তারা দলের সঙ্গে বেইমানি করবেন।

কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির নেতা জাহিদুল ইসলাম বিপস্নব বলেন, আমরা অনেক মামলা-হামলার স্বীকার হয়েছি। দলের দুঃসময়ে যারা ছিলেন না, তারা এখন বিএনপিতে ভালো জায়গায় আছেন।

নীলফামারী জেলা বিএনপির নেতা মাসুদ চৌধুরী বলেন, দলের ভেতরে এখন বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছি। কিছু সুবিধাবাদী দেখতে পাচ্ছি। এসব সুবিধারা ত্যাগিদের বিতাড়িত করতে চায়। দলের অনেক নেতা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এই ত্যাগীদের কথা যাতে আমরা ভুলে না যাই। পাশাপাশি বর্ধিত সভার মতো করে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সভা করারও পরামর্শ দেন তারা।

তবে সব নেতার বক্তব্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অভিন্ন সুর ছিল। তারা বলেন, দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে অনাতে হলে অবশ্যই দ্রম্নত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। দুই-একজন নেতা তাদের বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা ছিল। তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করলেও এই সরকার কালক্ষেপণ করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে