সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর

বেশিরভাগ নলকূপে উঠছে না 'পানি'

স্বদেশ ডেস্ক
  ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
যশোরের চৌগাছায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দূর-দূরান্তে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন নারীরা -যাযাদি

গত কয়েকদিনের খড়তাপে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। খাল-বিল, নালা-ডোবা, পুকুর শুকিয়ে চৌচির। চৈত্রের শেষে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ভয়াবহ সেচ পানি সংকটে পড়েছেন কৃষকরা। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, লোডশেডিং ও পর্যাপ্ত ভোল্টেজ না থাকায় সেচ পাম্প দিয়ে পানি উঠছে না। মাঠের পর মাঠ পানি শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। ফলন্ত ধানে পর্যাপ্ত সেচ না দেওয়া গেলে খরায় পুড়ে ধানে চিটা হওয়ায় আশঙ্কায় কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের। ঝরে পড়ছে আম। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি জানান, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় যশোরের চৌগাছা উপজেলার বেশিরভাগ নলকূপ দিয়ে পানি ওঠানো যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও গভীর নলকূপেও তোলা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় পানি। তীব্র দাবদাহে এ অবস্থা আরও প্রকট হওয়ায় দেখা দিয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন স্থানীয়রা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, উপজেলায় সাধারণত পানির স্তর গড়ে ৩০ থেকে ৮০ ফুট গভীরে। বেশিরভাগ এলাকায় এ স্তরে পৌঁছালেই পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় অস্বাভাবিকভাবে নীচে নেমে গেছে পানির স্তর। প্রতি বছর তীব্র দাবদাহে জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত এ অবস্থা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। এবারও উজেলার বেশিরভাগ এলাকার নলকূপে পানি উঠছে না। বিশেষ করে সিংহঝুলি ও ফুলসারা, জগদিশপুর ও পাশাপোল ইউনিয়নে পানি সংকট চরমে পৌঁছেছে। সুপেয় পানির সংকট দেখা দেওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জন সাধারণকে।

শুধু অগভীরই নয়, কোনও কোনও এলাকায় পানি উঠছে না গভীর নলকূপেও। দেড়শ' থেকে দুইশ' ফুট গভীরেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

উপজেলার সিংহঝুলি গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি রহিদুল ইসলাম খান বলেন, 'গ্রীষ্মে কোনও অগভীর নলকূপে পানি উঠে না। অন্য এলাকা থেকে খাবার পানি আনতে হয়। ব্যয়বহুল হওয়ায় সব মানুষের পক্ষে গভীর নলকূপ স্থাপন সম্ভব হয় না। এলাকার মানুষকে অনেক কষ্ট করে পানি সংগ্রহ করতে হয়।'

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ফেরদৌসি খাতুন বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনের প্রয়োজন পড়ে। ফলে পানির স্তর দিনদিন আশঙ্কাজনকভাবে নীচে নেমে যাচ্ছে। তবে নদী খনন এবং ভূ-উপরস্থ পানির দূষণরোধ ও ব্যবহার বাড়ানো হলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হতে পারে। এছাড়া বৃষ্টিপাত হলে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।

মহেশপুর (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি জানান, প্রচন্ড গরমে ঝিনাইদহের মহেশপুরে খাল-বিল, নালা-ডোবা, পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির দুষ্প্রাপ্যতায় বেড়ে যাচ্ছে সেচ খরচ। ধানে পর্যাপ্ত পানি না দেওয়া গেলে ইরি-বোরো মৌসুমের ধানের লক্ষ্যমাত্র পূরণ করা সম্ভব না বলে মনে করছেন কৃষক। গভীর বা অধিক শক্তিশালী সেচ পাম্প দিয়ে কিছুটা পানি পাওয়া গেলেও ছোট পাম্পগুলোতে একেবারেই পানি উঠছে না। স্বাভাবিক সময়ে ১০-১২ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া গেলেও বর্তমানে মাত্র ৩ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় একই অবস্থা হয়েছে এলাকার নলকূপগুলোতে। অনেক নলকূপ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বেশিরভাগ নলকূপে এখন আর আগের মতো পানি উঠে না। ফলে বিশুদ্ধ পানির অভাবে দূরদূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করছেন এলাকাবাসী। কেউ হেঁটে, কেউ মোটর সাইকেলে আবার কেউ বা ভ্যান গাড়িতে করে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন। এদিকে সারা দিনের চরম খড়তাপ ও ভ্যাপসা গরমের সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সেহরি, ইফতার কিংবা তারাবির নামাজের সময়ও বিদু্যৎ বন্ধ থাকায় চরম অস্বস্তিতে দিনপার করছেন এ এলাকার মানুষ।

অতিরিক্ত খড়তাপে পুকুরের পানি কমে উত্তপ্ত হয়ে মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে মারা যাচ্ছে। পুকুরের পাশের সেচ পাম্পে পানি না উঠায় কিছুই করা যাচ্ছে না। এতে করে মূলধন হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বহু মাছচাষি।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছর উপজেলায় বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৭৬০ হেক্টর। তবে এভাবে লোডশেডিং ও বৃষ্টি না হলে তা পূরণ করা সম্ভব না। এ বছর পাতিবিলা বিলপাড়া মাঠে কৃষক জামির হোসেন ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তিনি বলেন, পানির অভাবে পুরো মাঠ ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। পানির স্তর নিচে নেমে পানি না ওঠা, পর্যাপ্ত ভোল্টেজ ও অতিরিক্ত লোডশেডিংয়ের ফলে কোনোভাবেই জমিতে পানি দেওয়া যাচ্ছে না। এভাবে আর দুই এক দিন গেলে জমিতে ধানের থেকে চিটার ভাগ বেশি হবে।

সেচ পাম্প মালিক আব্দুল লতিফ জানান, পানির স্তর এত নিচে নেমেছে যে পাম্প চালু করে টিউবওয়েল চেপে বহু কষ্টে পানি তুলতে হচ্ছে। যেখানে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ১০-১২ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া যেত; সেখানে বর্তমানে মাত্র ৩ বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লোডশেডিং। এদিকে বিদু্যৎ থাকাকালীন সময় পর্যাপ্ত ভোল্টেজ থাকে না।

এ ব্যাপার উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপ-প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান বলেন, শুষ্ক মৌসুম, তার ওপর বৃষ্টি না হওয়ায় পানির লেয়ার ২০-২৫ ফিট নিচে নেমে গেছে। যে কারণে সাধারণ নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। তবে সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে পানি উত্তোলন করা যাচ্ছে। সাবমার্সিবল ১শ' ফিট পর্যন্ত পানি হাউজিং করে রাখে।

সাপাহার (নওগাঁ) প্রতিনিধি জানান, নওগাঁর সাপাহার উপজেলায় প্রচন্ড দাবদাহ ও খরার কারণে মাটিতে ঝরে পড়ছে কৃষকের স্বপ্নের আম। তীব্র খরা আর টানা বৃষ্টিহীনতায় শুকিয়ে গেছে পুকুর, খাল ও ডোবাগুলো। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, পুকুর, খাল ও ডোবাগুলো দীর্ঘদিন খনন ও সংস্কার না করায় প্রচন্ড রোদ ও খরতাপে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং প্রচন্ড দাবদাহে ঝরে পড়েছে গাছের আম। ফলে অন্য বছরের চেয়ে এ বছর উপজেলায় আমের ফলন বিপর্যয় ঘটতে চলেছে।

এলাকার অনেক আম বাগানি জানান, প্রচন্ড খরতাপে গাছে পানি ও ওষুধ স্প্রে করে আম রক্ষার চেষ্টা করেও আটকাতে পারছেন না। প্রচন্ড খরতাপ ও রোদে ঝরে পড়েছে বেশিরভাগ গাছের আমের গুটি। তাছাড়া সেচের জন্য পানি না থাকায় বাগানে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না।

উপজেলার পিছলডাঙ্গা গ্রামের আমচাষি মুমিনুল হক, দেলোয়ার হোসেন, জবই গ্রামের শাহজাহান আলী জানান, এ বছর শুরুতে প্রতিটি বাগানে যে পরিমাণ মুকুল এসেছিল এবং পরবর্তীতে আমের গুটি দেখে সবাই আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে প্রচন্ড দীর্ঘ খরা ও মাত্রাতিরিক্ত দাবদাহের কারণে এখন গাছের আমের গুটি ঝরে পড়ছে। আমচাষিদের আশায় গুড়ে বালিতে পরিণত হতে বসেছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান টকি জানান, 'আমাদের পক্ষ থেকে আম রক্ষার্থে ১৫ দিন পরপর বাগান মালিক ও চাষিদের আমের গাছে বেশি করে পানি দিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে এবং ছত্রাকনাশক ও বোরন স্প্রে করতে বলা হচ্ছে।'

সাপাহার বাজার আম বাগান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, খরার পাশাপশি প্রাকৃতিক কোনো বড় ধরনের দুর্যোগ না হলে আমের বাম্পার ফলন না হলেও চাষিরা তাদের খরচ পুশিয়ে নিতে পারবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে