সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

জমে উঠেছে শীতের পিঠা বিক্রি

বাড়তি আয়ে সংসারে আসছে সচ্ছলতা
স্বদেশ ডেস্ক
  ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
মাদারীপুরের শিবচর ও রাঙামাটির লংগদুতে রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি করে বাড়তি আয় করছেন দুই বিক্রেতা -যাযাদি

পিঠা শুধু লোকজ খাবার নয়, এটা বাংলা ও বাঙালির লোকজঐতিহ্য। এর সঙ্গে মিশে আছে আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পারিবারিক ও সমাজজীবন থেকে পিঠা তৈরির আয়োজন কমে যাচ্ছে। তবে এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে একশ্রেণির মৌসুমি নারী-পুরুষ ব্যবসায়ী বা পিঠা বিক্রেতা।

সকালের কুয়াশা কিংবা সন্ধ্যার হিমেল বাতাসে পিঠার সুগন্ধি ধোঁয়ায় মন আনচান করে ওঠে। তাই তো রাস্তার পাশে, বিভিন্ন ওলিতে গলিতে গড়ে ওঠা মৌসুমি পিঠার দোকানে ভিড় বাড়ে ক্রেতাদের।

শীত এলেই শহর ও গ্রামীণ হাটবাজারে নানা রকম পিঠা বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে ভাঁপা পিঠা, তেলের পিঠা ও চিতই পিঠা। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটপাতে শীতের পিঠার ব্যবসা জমে উঠে। চুলার অল্প আঁচের ধোঁয়া উড়ছে। গরম গরম ভাঁপা, চিতই নামছে। ক্রেতারা এসে সারিবদ্ধ হয়ে পিঠা কিনছেন।

শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, শীতের আমেজে মাদারীপুর শিবচরের অলি-গলির ফুটপাতে জমে উঠেছে ভাপা ও চিতই পিঠা বিক্রির ধুম। উপজেলার রবীন্দ্র সরবর, লালন মঞ্চের পুকুর পাড়, পাঁচ্চরসহ বিভিন্ন অলি-গলিতে রাস্তার ফুটপাতে ও মোড়ে মোড়ে চলছে বাহারি পিঠা বিক্রির ধুম। শীতের সময়ে পিঠার দোকানে ক্রেতার সংখ্যা বেশি। ধোঁয়া ওঠা গরম পিঠায় আড্ডা জমে উঠে পিঠার দোকানে। স্থায়ী বা মৌসুমি পিঠার দোকানগুলোর অধিকাংশই পরিচালিত হয় নারীদের মাধ্যমে। সংসারে পুরুষের পাশাপাশি উপার্জনে বাড়তি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য দিন দিন বেড়েছে নারীদের এই পিঠার দোকান। এতে করে সংসারে কিছুটা বাড়তি উপার্জন হচ্ছে।

ভাপা পিঠার পাশাপাশি বিক্রি করছে চিতই পিঠাও। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরেই জমে উঠে এসব পিঠা বিক্রি। এই পিঠার স্বাদ পেতে রিকশা-চালক, দিনমজুর, শিশু-কিশোর, ছুটির দিনে চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী সব শ্রেণি-পেশার মানুষই পিঠার দোকানে ভিড় করছেন। আবার কেউ বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের জন্যও পিঠা কিনে নিয়ে যান। এসব পিঠার মধ্যে ভাপা ও চিতই ১০ টাকায় বিক্রি হয়।

পিঠা কিনতে এসে অপেক্ষায় থাকা সজিব মিয়া জানান, 'শীতের সময় চিতই, ভাপা পিঠা খেতে ভালো লাগে। বিশেষ করে নানা রকম ভর্তা দিয়ে গরম চিতই পিঠার স্বাদই আলাদা। এটা গরমের সময় ততটা খাওয়া যায় না। তা ছাড়া ভাপা পিঠাও বেশ মজার। বিকালের নাশতায় চিতই আর ভাপা পিঠা যোগ করে নতুন মাত্রা।'

পিঠা কিনতে আসা জান্নাতি আক্তার বলেন, 'শীত আর পিঠা কেমন যেন একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। ছোট বেলায় মা পিঠা বানিয়ে দিত আর সন্ধ্যার সময় স্কুল থেকে পাওয়া নতুন বই নিয়ে পড়তে পড়তে পিঠা খেতাম। সেগুলো স্মৃতি হলেও শীত আসলে পিঠা খেতেই হবে। তাই দোকানে আসা পিঠা খাওয়ার জন্য।'

পাঁচ্চরে আলাপের সময় পিঠা বিক্রেতা সালমা বেগম জানান, 'শীতে চিতই পিঠার চাহিদা বাড়ে। নানা রকম ভর্তা দিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পিঠা খেতে ভিড় লেগে থাকে। একই সঙ্গে ভাপা পিঠাও প্রচুর বিক্রি হয়। শীতে গরমের যন্ত্রণা থাকে না। লোকজন শান্তি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে খেতে পারে। এ কারণে শীতে পিঠা বিক্রি দুই থেকে তিনগুণ বাড়ে।'

আরেক পিঠা বিক্রেতা রেনু বেগম জানান, শীত আসতেই কাজের চাপ বেড়ে যায়। পিঠা বানানো থেকে সবকিছু করতে হয়। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত সময় পার হয়। তিনি ৫টি চুলায় পিঠা তৈরি করেন। প্রতিদিন বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে পিঠা বানানো ও বিক্রি।

পিঠা বিক্রেতারা আরও জানান, বছরের এ সময় শীতকালীন পিঠার বেচা-বিক্রি বেশি হয়। তাইতো এই সময়ে দোকানিরা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারেন। শীত যত বাড়বে তাদের পিঠা বিক্রিও তত বাড়বে।

লংগদু (রাঙামাটি) প্রতিনিধি জানান, আবহমান গ্রাম বাংলায় শীতের পিঠা গ্রামীণ ঐতিহ্য। শীত মানেই পিঠা-পুলির ঘ্রাণ। কুয়াশা মুড়ানো শীতের হিমেল হাওয়ায় ধোঁয়া উঠা ভাঁপা-চিতই পিঠার স্বাদ না নিলে যেন তৃপ্তি মেটে না অনেকের। শীত মৌসুমে গ্রামীণ বধূরা রকমারি পিঠা তৈরি করেন। শীতের পিঠার মধ্যে ভাঁপা পিঠা একটি অন্যতম পিঠা।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাঙামাটির লংগদু উপজেলার অধিকাংশ স্থানে বসেছে অস্থায়ী পিঠা বিক্রির দোকান। অল্প পুঁজি আর কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় পিঠা ব্যবসায় নেমেছেন অনেকেই। উপজেলার মাইনী বাজার, বাইট্টাপাড়া বাজার ও লংগদুসহ বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট পিঠার দোকান সাজিয়ে বসছে নারী-পুরুষ বিক্রেতারা।

অনেকেই এই শীতের মৌসুমে পিঠা বিক্রিকে বেছে নিয়েছেন মৌসুমি পেশা হিসেবে। বেচা-কেনাও বেশ ভালোই চলে। চলতি পথে থেমে বা অস্থায়ী দোকানের বেঞ্চে বসেই সন্ধ্যায় হালকা নাশতাটা সেরে নিচ্ছেন গরম গরম ভাঁপা পিঠা কিংবা চিতই পিঠা দিয়ে। কেউবা চিতই পিঠার সঙ্গে নিচ্ছেন ঝালযুক্ত সরিষা বাটা। প্রতিটি ভাঁপাপিঠা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা এবং চিতই পাঁচ টাকায়। সরিষা বাটা থাকছে ফ্রি।

বাজারে অস্থায়ী পিঠা বিক্রেতা আলমাস মিয়া জানান, শীতের পিঠা অনেক ভালো চলে। ভাপা ১০ টাকা, চিতই দু'পিস ১০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। যুবক-মুরব্বি সব বয়সের লোকই আসেন তার দোকানে পিঠা খেতে। অনেকে বাসায় নিয়ে যান।

পিঠা ক্রেতা রহমান জানান, 'কর্মব্যস্ততার কারণে চাল ভেঙে আটা করে পিঠা বানানোর সময় সুযোগ আর হয় না। ঝামেলা ছাড়াই স্বল্প দামে হাতের নাগালেই এখন পিঠা পাই। তাই পথের ধারে পিঠাই আমাদের ভরসা।'

পিঠা কিনতে আসা বুলবুল বলেন, 'শীতকালের খাবার মধ্যে পিঠা অন্যতম। আগে যদিও বাড়িতে এসব পিঠা বানানোর হিড়িক পড়তো এখন তা আর দেখা যায় না।'

অস্থায়ী দোকানগুলোর সামনে সারিবদ্ধ বসে পিঠা খাচ্ছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি আব্দুর রহিম বলেন, 'আমি আর আমাদের কলেজ জীবনের কিছু বন্ধুদের নিয়ে আজ সন্ধ্যায় পিঠা আড্ডায় মিলেছি।'

পিঠা বিক্রেতারা জানান, ভাপা পিঠা তৈরির উপকরণ হচ্ছে চালের গুঁড়ো, নারকেল, খেজুরের গুঁড়। গোল আকারে পাতিলে কাপড় পেঁচিয়ে ঢাকনা দিয়ে হাঁড়ির ফুটন্ত গরম পানিতে ভাপ দিয়ে তৈরি হয় ভাপা পিঠা। অন্যদিকে, চালের গুড়ো পানিতে মিশিয়ে মাটির হাঁড়িতে তৈরি করা হয় চিতই পিঠা।

গ্রামের মানুষ নবান্নের আনন্দে যেভাবে শীতকে বরণ করে নিচ্ছে- হোক তা ঘরে কিংবা বাইরে। বাহারি পিঠার স্বাদে শীতকে বরণ করে নিচ্ছে এখন। শীতের মৌসুমি পিঠার স্বাদ এখন চাইলেই পাওয়া যায় জীবনে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে