সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

আজও অনুদ্ঘাটিত নবীগঞ্জের কালো পাথরের রহস্য

এটিএম সালাম, নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ)
  ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি বৃহত্তর সিলেটের এক কোণে অবস্থিত নবীর নামানুসারে ঐতিহ্যবাহী নবীগঞ্জ উপজেলা। অসংখ্য পীর, গাউস, কুতুব, আউলিয়া এবং বহু গুণীজনের জন্ম হয়েছিল এ উপজেলায়। পার্শ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারের সীমান্ত ঘেঁষে উপজেলার এক প্রান্তে অবস্থিত নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগনা। অসংখ্য বাঁশ ও গাছ ঘেরা এ পরগনার দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট পূর্ব দেবপাড়া গ্রামে অবস্থিত সুউচ্চ একটি পাহাড়। এ পাহাড়ের দক্ষিণে রয়েছে আরও একটি উঁচু পাহাড়, নাম মীরটিলা। এছাড়া উঁচু-নিচু আরও অনেক টিলা এখানে বিদ্যমান। এর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হচ্ছে 'কুড়িটিলা'। আর এ কুড়িটিলায় অবস্থিত হাজার বছরের ইতিহাস, কালের সাক্ষী নিখুঁত এক কালো পাথর। রহস্যময় এ পাথরটি আজও উৎসুক মানুষের মনের খোরাক জোগায়। এ পাথরটিকে একনজর দেখার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন ছুটে আসেন দিনারপুর পরগনার ছোট্ট গ্রামে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ৯ ফুট প্রস্থ রহস্যময় এ পাথরটির মাঝখানে একটি কুড়ালের ছেদ রয়েছে। পাথরের পাশে ছোট ছোট দুটি গাছ এবং কিছু উপরে একটি বিরাট গাছ অবস্থিত। পাহাড়ের আশপাশে ও এলাকার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রহস্যময় এ কালো পাথরের হাজার বছরের ইতিহাস।

এই পাহাড়ের অদূরেই রয়েছে সদরঘাটের সুপ্রাচীন ইমামবাজার। শত শত বছর আগের কথা। সে সময় এ বাজারে বড় বড় মাছ কেটে বিক্রি হতো। মাছের পরিত্যক্ত অংশ ফেলে দিতেন স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা। আর ফেলে দেওয়া মাছের এই পরিত্যক্ত অংশগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যেতেন সাদা পোশাক পরিহিত এক দরবেশ। আর এ দৃশ্য প্রতিদিন মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করতেন পূর্ব দেবপাড়ার সামছু মিয়া নামের এক ব্যক্তি। সামছু ছিলেন বিখ্যাত ডাকাত।

প্রতিদিনের মতো ওই দরবেশ ইমামবাজার থেকে মাছের ফেলে দেওয়া অংশ কুড়িয়ে নিয়ে কুড়িটিলা পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছেন। ওঁৎপেতে থাকা সামছু দরবেশের পিছু নেন। কুড়িটিলা পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে সামছু দেখতে পান ছোট্ট একটি পাথরের সামনে গিয়ে দরবেশ ইশারা করতেই পাথর সরে গিয়ে ওই স্থানে একটি সুড়ঙ্গ রাস্তা হয়ে গেছে। আর ওই রাস্তায় দরবেশ ভেতরে ঢুকে গেলেন। সামছু মিয়া অতি সতর্কতার সঙ্গে পিছু নিলেও দরবেশের স্বচ্ছ হৃদয়ের আয়নাকে ফাঁকি দিতে পারেননি। ধরা পড়ে যায় একজন আগন্তুক তার পিছু নিয়েছে। এই ভেবে দরবেশ পাথরের কপাট খোলা রেখেই ভেতরে চলে যান। সামছু মিয়াও এগিয়ে যান পাথরের কপাটের কাছে। দেখতে পান সেখানে একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। এ পথ দিয়ে তিনিও ভেতরে ঢুকে পড়েন। ভেতরে ঢুকে সামছু মিয়া দেখতে পান এক কল্পনাপুরীর রাজপ্রাসাদের দৃশ্য। চতুর্দিকে বিচিত্র কারুকাজ খচিত এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। নানা ফুলের মিষ্টি সুভাষ। এর মধ্যে বসে আছেন সাদা পোশাক পরিহিত ৭ জনের এক সুসজ্জিত বাহিনী। পাশে খাবারের আয়োজন। ৭ জন দরবেশের সামনে খাবার পেস্নট এসেছে ৮টি। অবাক কান্ড। এ দৃশ্য দেখে দরবেশরা একে অপরকে বলাবলি করছেন একটি পেস্নট বেশি কেন এ সময় হঠাৎ দরবেশ দলপতি সবার উদ্দেশে বলেন, আজ আমাদের একজন মেহমান আছেন। সামছু মিয়া তখনও লুকিয়ে সবকিছু দেখছিলেন এবং শুনছিলেন।

দলপতির কথায় দরবেশরা অবাক হন এবং এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করেন। পরে দরবেশ দলপতির কথায় সামছু আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন। তাৎক্ষণিকভাবে আদর-অভ্যর্থনা দিয়ে মেহমান সামছু মিয়াকে খাবার আসনে বসানো হয়। দুর্দান্ত সাহসী সামছু মিয়া উৎফুলস্ন মনে তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেন। পরে দরবেশরা সামছুকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি এ খবর কাউকে বল তা হলে তোমার মারাত্মক ক্ষতি হবে। বাড়িতে ফিরে সামছু গভীর চিন্তায় পড়েন। তার ভেতর কমনীয়ভাব চলে আসে। সবাই সামছুকে আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ খুলে বলার জন্য চাপ দেয়। সামছুর বৃদ্ধ মাতার আবদারে মুখ খোলেন সামছু। দরবেশের সেই সতর্কবাণী শেষ পর্যন্ত কার্যকর হলো। ঘটনাটি তার আত্মীয়-স্বজনদের বলার ৩ দিনের মাথায় সামছুর মৃতু্য ঘটে। সামছু অবশ্য ঘটনা খুলে বলার আগে এরকম ইঙ্গিত করেছিলেন তার স্বজনদের। শেষে পাথরের কাছেই সামছুকে দাফন করা হয়। ওই এলাকার দিলাওর মিয়া বলেন, প্রায় একশ' বছর আগে এ পাথরের আয়তন ছিল দৈর্ঘ্য ৬ ফুট ও প্রস্থ ৪ ফুট। বর্তমানে পাথরটির আয়তন দৈর্ঘ্য ১৫ ও প্রস্থে ১০ ফুট রয়েছে।

এখানে পাথরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো খাদেম নেই। পাশের রোহেল মিয়া নামের কম বয়সি যুবককে বসে থাকতে দেখা গেছে। আগন্তুকদের কাছ থেকে সিন্নি ও মোমবাতির জন্য ১০-২০ টাকা রাখা হয়। এ ব্যাপারে তিনি জানান, যারা স্বেচ্চায় দেন তাদের কাছ থেকে রাখা হয় এবং তা দিয়ে সপ্তাহে সিন্নি করা হয়ে থাকে। একবার জনৈক ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় পাহাড়ের নিচে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত গরমের কারণে এলাকা ত্যাগ করেন।

আজও অনেকে মানত নিয়ে পাথরের কাছে এসে তা পূর্ণ করেন। কুড়িটিলার রহস্যময় এ পাথরটিকে একনজর দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত নারী-পুরুষ এখানে আসছেন। সামছু মিয়ার স্মৃতিতে অম্স্নান এ রহস্যময় পাহাড় ও পাথর যেন আজও এ দেশের পথভ্রষ্ট মানুষদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যেন উৎসুক মানুষের মনের খোরাক জোগায় এ কালো পাথরটি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে