শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গোপসাগরে লাল জোয়ার উদ্বিগ্ন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা

চট্টগ্রাম অফিস
  ১০ মে ২০২১, ০০:০০

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকুলজুড়ে বঙ্গোপসাগরে আছড়ে পড়ছে লাল জোয়ার। গত ফেব্রম্নয়ারি মাসের শেষদিক থেকে জোয়ারের সময় লাল পানি আছড়ে পড়ার বিষয়টি নজরে আসে বলে জানান স্থানীয় জেলে ও উপকূলীয় বাসিন্দারা।

দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে এই লাল জোয়ার সৃষ্টি হতে পারে মনে করছেন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। বৃষ্টিপাত হলে এই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ডক্টর শফিকুর রহমান।

তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে লাল জোয়ার সৃষ্টির বিষয়টি গত মার্চ মাসের শুরুর দিকে নজরে আসে। এরপর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পরপর দুটি তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকার হ্যাচারিগুলোতে প্রায় দেড় কোটি মাছের পোনা মারা যায়। এতে কক্সবাজার উপকূলের অধিকাংশ হ্যাচারিতে মাছ উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ে। যা চরম উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বায়োলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে আমরা লাল জোয়ারের বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। তবে বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। এ লাল জোয়ারই বঙ্গোপসাগরে দুটি তিমির মৃতু্যর অন্যতম কারণ হতে পারে।

তিনি বলেন, এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো পস্নাঙ্কটনের কারণে সাগরের পানির রং হলুদ বা বাদামিতে রূপান্তরিত হয়। হার্মফুল এলগার্ল বস্নুম বা এইচএবি নামে পরিচিত সেই বাদামি বা হলুদ পানির জোয়ারই বিশ্বব্যাপী লাল জোয়ার নামে পরিচিত। এ কারণে সাগরের মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবন হুমকির মুখে পড়ে।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভূ-তাত্ত্বিক ওশানোগ্রাফি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, নদী ও খাল থেকে বয়ে আসা হালকা স্বাদু পানি যখন সমুদ্রের লবণাক্ত ভারী পানির সঙ্গে মেশে, তখন সেটি সমুদ্রের পানির কলামে হরাইজন্টালি বা আনুভূমিকভাবে স্তর পুনর্বিন্যাস (স্ট্রেটিফিকেশন) না করে ভার্টিক্যালি বা উলস্নম্বভাবে বিন্যস্ত হলেই সাগরের পানিতে অক্সিজেন শূন্যতা তৈরি হয়। যেটি লাল জোয়ার নামে পরিচিত।

তিনি বলেন, আবহাওয়াগত

\হকারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাগরগুলোয় মাঝেমধ্যে লাল জোয়ারের ঘটনা ঘটে। ক্রমাগত তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে এবং দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হলে উপকূলবর্তী সাগর ও নদীতে এক ধরনের ক্ষতিকর ফাইটো পস্নাঙ্কটন (উদ্ভিজ্জ অণুজীব) বিস্তার করে। এই পস্নাঙ্কটনগুলো পানির কলামে মিশে থাকা অক্সিজেন ওপরের দিকে তুলে আনে। যার কারণে পানির নিচের দিকে অক্সিজেন শূন্যতা তৈরি হয় এবং পানিতে বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি জলজ প্রাণীর জন্য হয় মারাত্মক।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ ফরিদ উদ্দিন জানান, গত ৬ মাসে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় কেবল একবারই সামান্য বৃষ্টিপাত হয়েছে। যে কারণে গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির ওপরে ওঠানামা করছে। এতে সাগরে লাল জোয়ার সৃষ্টি হতে পারে।

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার সাগর তীরবর্তী কুমিরা জেলেপলস্নীর বাসিন্দা পরিতোষ দাস জানান, সাগর থেকে মাঝেমধ্যে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি ও আবর্জনা ভেসে আসে। কিন্তু গত প্রায় একমাস ধরে জোয়ারের সময় যে লাল পানি আছড়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে, তা আগে কখনো দেখা যায়নি।

কক্সবাজারের কলাতলীর জেলে মোহাম্মদ শরীফ বলেন, গত প্রায় ২/৩ মাস ধরে সাগরের পানি ঘোলাটে। যে কারণে মাছও ধরা পড়ছে খুব কম। এ ছাড়া গত মাসের শেষদিকে কক্সবাজারের চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিগুলোর প্রায় দেড়শ কোটি পোনা মারা গেছে। এজন্য সাগরের বিষাক্ত পানিকেই দুষছেন হ্যাচারি মালিকরা।

কক্সবাজারের চিংড়ি পোনা হ্যাচারিগুলোর সংগঠন শ্রীম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (শ্যাব) মহাসচিব নজিবুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজারের ৩০টি হ্যাচারি গত ফেব্রম্নয়ারি থেকে পোনা উৎপাদন করছে। কিন্তু এপ্রিলের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে হঠাৎ হ্যাচারিগুলোর পোনা মরে যেতে শুরু করে। ইতোমধ্যে প্রায় দেড়শ কোটি পোনা মরে যাওয়ায় অধিকাংশ হ্যাচারির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, কক্সবাজারের হ্যাচারিগুলোতে সাগর থেকে সংগৃহীত লবণাক্ত পানিতে কৃত্রিম উপায়ে মা মাছ থেকে পোনা ফোটানো হয়। কিন্তু সাগরের পানি বিষাক্ত হয়ে পড়লে পোনা মারা যায়। এ ছাড়া গত মার্চ মাসে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর পর দুটি তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। যা সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে