সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
টাঙ্গাইল-৩

আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদের সুযোগ নিতে চায় বিএনপি

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল
  ১৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী আমেজে মেতে ওঠেছে টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা নানা কৌশলে আগাম নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা স্ব-স্ব অবস্থান থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সেবামূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডসহ দোয়া মাহফিল এবং ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থিতা জানান দিচ্ছেন।

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনটি ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির আসন হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইদুর রহমান খান মোহন এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা তিনবার বিএনপি মনোনীত প্রার্থী লুৎফর রহমান খান আজাদ নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়ে সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে তিনি ঘাটাইল উপজেলার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দীর্ঘদিন দখলে থাকা আসনটি বিএনপির হাতছাড়া হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর এ আসনটি আওয়ামী লীগের দখলে আসে। বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মতিউর রহমান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই এমপি নির্বাচিত হন। তিনি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদকে পরাজিত করেন। ডা. মতিউর রহমান ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ায় টাঙ্গাইল-৩ আসনটি শূন্য হয়। ওই বছরের ১৮ নভেম্বর শূন্য আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা শহিদুল ইসলাম লেবু। কিন্তু তার মনোনয়নকে প্রত্যাখ্যান করে নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আমানুর রহমান খান রানা। বিএনপি ওই উপ-নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপি বিহীন নির্বাচনে আমানুর রহমান খান রানা নৌকার প্রার্থী শহিদুল ইসলাম লেবুকে সহজেই পরাজিত করেন। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমানুর রহমান খান রানা দলীয় মনোনয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ সময় টাঙ্গাইল ও ঘাটাইলে তাদের পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়। টাঙ্গাইল শহরের 'খান পরিবার' ঘাটাইলেও প্রতাপশালী হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশি তদন্তে বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় আমানুর রহমান খান রানা ও তার ভাইদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পরে তারা আত্মগোপনে চলে যান। এ সময় ঘাটাইল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আমানুর রহমান খানের বিরোধীদের হাতে চলে যায়। পরে আমানুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করে তিন বছরের বেশি সময় হাজতে থাকার পর জামিনে মুক্ত হন। আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি ঘাটাইলেই বেশি সময় অবস্থান করেন। জেলা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় তার বাবা সোনালী ব্যাংকের সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক আতাউর রহমান খানকে। আতাউর রহমান খান এখন এ আসনের সংসদ সদস্য। আতাউর রহমান খান সংসদ সদস্য হিসেবে সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করলেও ছায়া এমপি হিসেবে আমানুর রহমান খান রানা সব কাজ তদারকি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

এদিকে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আমানুর রহমান খানের তিন ভাইয়ের মধ্যে টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি এখনো জেল-হাজতে। অপর ভাই ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাঁকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পাও ওই মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। টাঙ্গাইল শহরের 'খান সাম্রাজ্য'র পতন হলেও ঘাটাইলে এখনও তাদের আধিপত্য রয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনে কে পাবেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন- বর্তমান এমপি আতাউর রহমান খান? সাবেক এমপি আমানুর রহমান খান রানা? উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম লেবু? প্রয়াত ডা. মতিয়ার রহমানের ছেলে ঢাকা ভিক্টোরিয়া হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান তানভীর রহমান? কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান? নাকি অন্য কেউ-তা নিয়ে সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে দলের মধ্যে বিভেদ আরও বেড়েছে। ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ এবং মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। দলের ভেতর গড়ে ওঠেছে আরেক দল। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে এ আসনে আওয়ামী লীগের অন্তঃকোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগের এ কোন্দলের সুযোগ নিতে বিএনপি নেতাকর্মীরা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ভুলে একক প্রার্থী হিসেবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান খান আজাদকে বেছে নিয়েছেন। তারা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া।

এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যদের মধ্যে রয়েছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক ও পিপি এস আকবর খান, তেজগাঁও কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর অধীর চন্দ্র সরকার, ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক মাসুদুর রহমান আজাদ। বিএনপি থেকে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ওবায়দুল হক নাছির মনোনয়ন চাইতে পারেন। উপজেলা জাতীয় পার্টির (জাপা) সাধারণ সম্পাদক সুজাত আলীর নাম শোনা যাচ্ছে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের উপজেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান মনোনয়ন চাইবেন। তিনি মূলত একজন সাংবাদিক। তার বাবা হাবিবুর রহমান হাবিব মহান মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে ভূঞাপুরের মাটিকাটায় পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংসে অবদান রাখায় জাহাজমারা হাবিব নামে পরিচিতি পান। সে কারণে দলীয় প্রধানের প্রিয়ভাজন তিনি।

টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ইতোমধ্যেই নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়েছেন। নানা উছিলায় ভোটারদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। অনেকে কৌশলে জনসমর্থন নিজের পক্ষে টানতে অনেকটা সফলও হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান ২৩ দফা উন্নয়ন কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠনে উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন চষে বেড়াচ্ছেন। তার কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উপজেলা আওয়ামী লীগের সকল সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় এবং দলীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কার্যক্রম গণমানুষের সামনে তুলে ধরা, স্থানীয় উন্নয়নে জনসাধারণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, ঘাটাইলের সার্বিক উন্নয়নে সুপরিকল্পিত কর্মসূচি প্রণয়ন, সর্বস্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, সর্বস্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, উন্নয়ন প্রকল্পে টেকসই আনয়ন, ঘাটাইলকে আধুনিক মডেল উপজেলায় রূপান্তর করা ইত্যাদি। গণমানুষের চিকিৎসা সেবায় ইতোমধ্যে তিনি প্রতিটি ইউনিয়নে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংবলিত ফি মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা অব্যাহত রেখেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান জানান, তিনি ২০০১ সাল থেকে দলের মনোনয়ন চাইছেন। তারও আগে থেকে তিনি ঘাটাইলের গণমানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। দলীয়ভাবে তিনি দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের পথ পরিহার করে জনসাধারণকে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে কাজ করছেন। ঘাটাইলে আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধ সম্পর্কে তিনি জানান, দুই পক্ষের বিরোধ অনেকটা ব্যক্তি বা গ্রম্নপ কেন্দ্রিক। বিরোধকারীদের কাছে দল নয়, ব্যক্তি স্বার্থই বড় কথা- এ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ্বনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই শেষ কথা। তিনি আশা করেন, বিশ্ব মানবতার নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার তার কর্মের মূল্যায়ন করবেন।

ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম লেবু জানান, তিনি এ আসনে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। মনোনয়ন পেলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেবেন। তিনি আরও জানান, ঘাটাইল একটি শান্ত জনপদ, আমানুর রহমান খান হঠাৎ করে এসে ঘাটাইলে সন্ত্রাস ছড়িয়েছে। তবে উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় কোথাও এখন দলীয় নেতাকর্মীরা আমানুর রহমান খানের সঙ্গে নেই। ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সবাই ঐক্যবদ্ধ।

বর্তমান সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান জানান, সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড তিনি স্বচ্ছতার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি দল-মতের ঊর্ধে উঠে ঘাটাইলের এমপি হিসেবে সমহারে উন্নয়ন করেছেন। তিনি মহান সংসদে ঘাটাইলের উন্নয়নে একাধিকবার কথা বলেছেন। তিনি জেলা-উপজেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক হানাহানিতে জড়াননি। বিগত সময়ের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে উন্নয়ন ও কাজের ধারাকে অব্যাহত রাখকে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারও তাকেই দলীয় মনোনয়ন দেবেন বলে বিশ্বাস করেন।

প্রসঙ্গত, টাঙ্গাইল-৩ আসনে দুই লাখ ৭২ হাজার ৫২৯ জন ভোটার রয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষ এক লাখ ৩২ হাজার ৫৭৫ জন এবং নারী এক লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৪ জন।

আগামীকাল : টাঙ্গাইল-৪ আসনের বিস্তারিত

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে